দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারে চলমান অচলাবস্থা নিরসনে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। মার্কিন সিনেটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি তহবিল বিল পাস হওয়ার মাধ্যমে দেশটি শাটডাউনের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে। সোমবার স্থানীয় সময় ৬০-৪০ ভোটের ব্যবধানে এই বিলটি অনুমোদন লাভ করে, যা মঙ্গলবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি কর্তৃক প্রচারিত এক প্রতিবেদনে নিশ্চিত করা হয়েছে। এই পদক্ষেপ দেশটির প্রশাসনিক কার্যক্রমে নতুন গতি আনবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিল পাসে দ্বিদলীয় ঐকমত্য:
এই ঐতিহাসিক ভোটাভুটিতে উভয় দলের মধ্যে একটি বিরল ঐকমত্য দেখা গেছে। আটজন ডেমোক্র্যাটিক সিনেটর নিজেদের দলের মূল অবস্থান থেকে সরে এসে রিপাবলিকানদের সাথে বিলটির পক্ষে ভোট দেন। এই সমর্থন ছিল অত্যন্ত জরুরি, কারণ সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকানদের (৫৩-৪৭) পক্ষে প্রয়োজনীয় ৬০ ভোটের ন্যূনতম সীমা অর্জন করতে ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন অপরিহার্য ছিল। এটি প্রমাণ করে যে, সংকট নিরসনে দলীয় বিভেদ ছাপিয়ে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখযোগ্যভাবে, ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বেশ কজন প্রভাবশালী সদস্য এই বিলের সমর্থনে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন ডিক ডারবিন, জন ফেটারম্যান, ক্যাথেরিন কর্টেজ মাস্তো, ম্যাগি হাসান, টিম কেইন, অ্যাঙ্গাস কিং, জ্যাকি রোজেন এবং জিন শাহীন। তাঁরা তাঁদের দলের অধিকাংশ সদস্যের বিরোধিতা সত্ত্বেও বিলটি পাস করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অন্যদিকে, রিপাবলিকানদের মধ্যে কেন্টাকির সিনেটর র্যান্ড পলই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি বিলটির বিপক্ষে ভোট দেন, যা অধিকাংশ ডেমোক্র্যাটের অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। এই ব্যতিক্রমী ভোটাভুটি বিলটির দ্বিদলীয় গুরুত্ব আরও প্রকট করে তুলেছে।
অর্থায়ন ও পরিষেবা পুনরুদ্ধার:
এই বিলের সফল অনুমোদন মার্কিন প্রশাসনের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এর ফলে আগামী ৩১শে জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারি কার্যক্রম পুনরায় পূর্ণোদ্যমে চালু হবে। এর আওতায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব প্রতিষ্ঠান, যেমন খাদ্য সহায়তা প্রদানকারী সংস্থা এবং আইন প্রণয়নকারী সংস্থাগুলো সহ অন্যান্য সরকারি পরিষেবার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল নিশ্চিত করা হয়েছে। এটি কেবল সরকারি কর্মকর্তাদের কাজে ফেরার সুযোগই দেবে না, বরং নাগরিকদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবাগুলির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহও নিশ্চিত করবে।
বিলটি পাসে রিপাবলিকান সিনেটর সুসান কলিন্স একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বিল পাসের পর তিনি তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “আমরা সরকার পুনরায় চালু করার পথে রয়েছি। আমরা এই বিষয়টি নিশ্চিত করছি যে, ফেডারেল কর্মচারীরা তাঁদের ন্যায্য পাওনা এবং প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ এখন থেকে নিয়মিতভাবে পাবেন।” তাঁর এই বক্তব্য কেবল কর্মীদের আশ্বস্তই করে না, বরং সরকারের উপর সাধারণ জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেও সহায়ক ভূমিকা রাখে। এটি সরকারের দায়িত্বশীলতা এবং কর্মচারীদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধারই প্রতিফলন।
শাটডাউনের ভয়াবহ প্রভাব:
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম দীর্ঘতম এই ৪১ দিনের শাটডাউন দেশটির সরকারি পরিষেবাগুলোতে ব্যাপক স্থবিরতা এনেছিল। এর ফলে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল।
- ফেডারেল কর্মচারীদের সংকট: প্রায় ১৪ লক্ষ ফেডারেল কর্মচারী এই দীর্ঘ সময় ধরে হয় অবৈতনিক ছুটিতে বাধ্য হয়েছিলেন, অথবা কোনো বেতন ছাড়াই তাঁদের দৈনন্দিন দায়িত্ব পালন করে গেছেন। এটি তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করেছিল।
- বিমান চলাচল ব্যাহত: কর্মী সংকটের কারণে বিমান পরিষেবাতেও বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দেয়। প্রায় সাত হাজারেরও বেশি ফ্লাইট বিলম্বিত হয়েছে এবং দুই হাজারেরও অধিক ফ্লাইট বাতিল করতে হয়েছে, যা লাখ লাখ যাত্রীকে দুর্ভোগে ফেলেছে এবং দেশের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
- খাদ্য সহায়তা ব্যাহত: শাটডাউনের সবচেয়ে গুরুতর প্রভাবগুলোর মধ্যে একটি ছিল ৪ কোটি ১০ লক্ষ নিম্ন আয়ের মার্কিনিদের জন্য অপরিহার্য খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির ব্যাহত হওয়া। এই জনগোষ্ঠী তাঁদের মৌলিক চাহিদা পূরণে সরকারের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল ছিল, যা শাটডাউনের কারণে চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছিল। এই পরিস্থিতি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং সামাজিক অস্থিরতা বাড়িয়ে তুলেছিল।
সিনেটে এই বিলটি পাশ হলেও, এটি আইনে পরিণত হতে হলে এখন মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের (House of Representatives) অনুমোদন প্রয়োজন। এই পদক্ষেপটি সম্পূর্ণ হলে শাটডাউনের সম্পূর্ণ অবসান নিশ্চিত হবে এবং দেশ স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরে আসবে।
