ভারতের রাজধানী দিল্লি এখন এক তীব্র পরিবেশগত সংকটের মুখোমুখি। শহরটির বায়ুদূষণ এমন এক ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে, যা জনস্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই অচলাবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে ভারত সরকার প্রথমবারের মতো এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে মেঘ বপন বা ‘ক্লাউড সিডিং’-এর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করেছে। দীপাবলির উৎসবকে ঘিরে আতশবাজির ধোঁয়া, কুয়াশা এবং অন্যান্য দূষণ উৎসের সম্মিলিত প্রভাবে দিল্লির বায়ুমান বিপজ্জনক পর্যায়ে নেমে আসার পর এই অভিনব উদ্যোগ গ্রহণ করা হলো।
বায়ুদূষণের মূল কারণ এবং ক্লাউড সিডিং-এর প্রয়োজনীয়তা
দিল্লির বায়ুদূষণের মাত্রা বিগত কয়েকদিনে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো দীপাবলির সময় পোড়ানো বিপুল পরিমাণ আতশবাজি। এছাড়াও, পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে কৃষিজ ফসলের অবশিষ্টাংশ পোড়ানো, কলকারখানার নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া, যানবাহনের ক্রমবর্ধমান দূষণ এবং কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর দূষণ সম্মিলিতভাবে রাজধানীর বাতাসকে শ্বাসরুদ্ধকর করে তুলেছে। শীতকালীন আবহাওয়ার কারণে বায়ুপ্রবাহের অভাব এবং বায়ুমণ্ডলের নিম্নস্তরে ঠাণ্ডা বাতাস আটকা পড়ার ফলে দূষণ কণাগুলো ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি ঘনীভূত হয়ে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এই মারাত্মক পরিস্থিতি মোকাবিলায় কৃত্রিম বৃষ্টি ঘটিয়ে বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা ও দূষিত গ্যাসগুলোকে নিচে নামিয়ে এনে বায়ু পরিশুদ্ধ করার লক্ষ্যেই ক্লাউড সিডিং-এর আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।
পরীক্ষামূলক প্রয়োগের বিস্তারিত বিবরণ
সরকারি কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে, সম্প্রতি দিল্লির আকাশে ক্লাউড সিডিং-এর পরীক্ষামূলক ফ্লাইট সফলভাবে পরিচালনা করা হয়েছে। এই বিশেষ অপারেশনের সময়, বিমান থেকে বিশেষভাবে তৈরি মেঘ বপন ফ্লেয়ার নিক্ষেপ করে মেঘের আর্দ্রতা ও তার প্রতিক্রিয়া নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। দিল্লির পরিবেশমন্ত্রী, মানজিন্দর সিং সিরসা, এই পরীক্ষাকে একটি প্রস্তুতিমূলক উদ্যোগ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, এর মূল উদ্দেশ্য হলো বিমান, সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি এবং জড়িত সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় ও সক্ষমতা যাচাই করা, যাতে বৃহত্তর পরিসরে এর প্রয়োগ সফল হয়। এটি নিশ্চিত করবে যে, যখন প্রকৃত কৃত্রিম বৃষ্টি ঘটানো হবে, তখন সমস্ত প্রযুক্তিগত এবং লজিস্টিক্যাল প্রস্তুতি সম্পন্ন থাকে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও আশার আলো
পরিবেশমন্ত্রী আরও জানান, এই প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষার ফলাফল যদি সন্তোষজনক হয়, তবে খুব শীঘ্রই দিল্লিতে কৃত্রিম বৃষ্টির বাস্তব প্রয়োগ শুরু হবে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে বাতাসে জমে থাকা সূক্ষ্ম ধূলিকণা ও অন্যান্য দূষিত উপাদানগুলোকে নিচে নামিয়ে এনে দিল্লির বাতাসকে শ্বাসপ্রশ্বাসযোগ্য করে তোলাই সরকারের মূল লক্ষ্য। এই প্রকল্পটি শুধু পরিবেশগত সমস্যা সমাধানের একটি উপায় নয়, বরং এটি দিল্লির মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনমান উন্নয়নের এক সুদূরপ্রসারী প্রচেষ্টার অংশ।
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী, রেখা গুপ্তা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (পূর্বে যা টুইটার নামে পরিচিত ছিল)-এ এক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি জানান যে, আবহাওয়া অধিদপ্তর ২৮, ২৯ ও ৩০ অক্টোবর দিল্লির আকাশে মেঘ থাকার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে। যদি আবহাওয়া পরিস্থিতি অনুকূল থাকে, তাহলে ২৯ অক্টোবরই দিল্লিতে প্রথম কৃত্রিম বৃষ্টি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী এটিকে কেবল প্রযুক্তিগতভাবে একটি ঐতিহাসিক উদ্যোগ হিসেবেই দেখছেন না, বরং তিনি এটিকে দিল্লির চলমান দূষণ মোকাবিলায় একটি বৈজ্ঞানিক সমাধানের নতুন দিগন্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এই প্রচেষ্টা প্রমাণ করে যে, সরকার ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতির পাশাপাশি উদ্ভাবনী প্রযুক্তির মাধ্যমেও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অঙ্গীকারবদ্ধ। ভবিষ্যতে এ ধরনের পদক্ষেপ অন্যান্য শহরগুলোর জন্যও অনুপ্রেরণা যোগাতে পারে, যা পরিবেশ সুরক্ষায় প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহারের এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
