বঙ্গোপসাগরের মোহনায় সুন্দরবনের কোলে এক আধ্যাত্মিক আবহ: ঐতিহ্যবাহী রাস উৎসবের সূচনা
সুন্দরবনের দুবলার চরের আলোরকোলে আজ সোমবার থেকে শুরু হচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শতবর্ষের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী তিন দিনব্যাপী রাস উৎসব। পূর্ণিমার পবিত্র তিথিতে পুণ্যস্নান ও বিশেষ পূজার মধ্য দিয়ে এই মহোৎসব উদ্যাপিত হয়। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে অবস্থিত এই সাগরতীরে ইতোমধ্যেই সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে, যেখানে ধর্মপ্রাণ পুণ্যার্থীরা একত্রিত হবেন আধ্যাত্মিক শান্তির অন্বেষণে। তবে, সুন্দরবনের পরিবেশগত সংবেদনশীলতা ও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এ বছরও রাস উৎসবে কোনো প্রকার মেলা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থেকে বিরত থাকা হয়েছে।
সুন্দরবনে প্রবেশে কঠোর বিধিনিষেধ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
রাস উৎসবকে কেন্দ্র করে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় বন বিভাগ কঠোর প্রবেশাধিকার ও নিরাপত্তা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। কেবলমাত্র সনাতন ধর্মাবলম্বী পুণ্যার্থীরাই বন বিভাগের সুনির্দিষ্ট পাঁচটি রুট ব্যবহার করে আলোরকোলে পৌঁছাতে পারবেন। অন্য কোনো ধর্মাবলম্বী কিংবা সাধারণ পর্যটকের জন্য এই সময়ে সুন্দরবনে প্রবেশ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যা এই পরিবেশ-সংবেদনশীল অঞ্চলের সুরক্ষায় একটি জরুরি পদক্ষেপ। এই বিধিনিষেধ নিশ্চিত করবে যে উৎসবটি তার পবিত্রতা এবং পরিবেশের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বজায় রেখে পালিত হয়।
পুণ্যার্থীদের যাত্রা: বিশ্বাস ও আনন্দ
খুলনার কয়রা উপজেলার কোবাদক ফরেস্ট স্টেশন থেকে আজ সকালে ৩০ জন পুণ্যার্থীর একটি দল দুবলার চরের উদ্দেশে তাদের আধ্যাত্মিক যাত্রা শুরু করেছে। এই দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন কয়রা কপোতাক্ষ মহাবিদ্যালয়ের প্রখ্যাত প্রভাষক বিদেশ রঞ্জন মৃধা। তিনি জানান, তাদের ট্রলারটি ৩৫ হাজার টাকায় তিন দিনের জন্য ভাড়া করা হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় বাজার-সদাই থেকে শুরু করে রান্নার সামগ্রী সবই সঙ্গে নেওয়া হয়েছে, যা ট্রলারেই প্রস্তুত ও ভক্ষণ করা হবে। জনাব মৃধা বলেন, “সকলেই অপার আনন্দ নিয়ে যাত্রা করছেন এবং ভালোভাবে ফিরে আসাটাই আমাদের মূল সফলতা।” এই যাত্রা কেবল একটি ভ্রমণ নয়, বরং সম্মিলিত বিশ্বাস ও প্রত্যাশার এক প্রতিচ্ছবি।
কয়রার মহারাজপুর এলাকার আরেক পুণ্যার্থী, মনজিত কুমার রায়, তার অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন। তিনি বলেন, “সুন্দরবনের বাটুলা নদী পেরিয়ে আমরা দুবলার চরের দিকে এগোচ্ছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, তবে আমাদের সকলের মনে অপার আনন্দ। পূর্ণিমার জোয়ারের নোনাজলে স্নান করলে পাপমোচন হয়—এই গভীর বিশ্বাস নিয়েই আমরা সকলে যাচ্ছি।” এই উক্তিটি পুণ্যার্থীদের হৃদয়ে প্রোথিত চিরন্তন বিশ্বাসকে তুলে ধরে, যেখানে প্রকৃতির মাঝে স্রষ্টার সান্নিধ্য খুঁজে পাওয়া যায়।
একইভাবে, কয়রার গুড়িয়াবাড়ী গ্রামের সুব্রত কুমার মণ্ডল এক সপ্তাহ পূর্বেই তার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। তিনি মাঝারি আকারের একটি ট্রলার তিন দিনের জন্য ভাড়া করেছেন এবং ২০ জন পুণ্যার্থীকে নিয়ে সকালে যাত্রা শুরু করেছেন, তাদেরও সাথে রয়েছে তিন দিনের প্রয়োজনীয় সকল বাজার-সদাই। এই প্রস্তুতিমূলক কর্মযজ্ঞ পুণ্যার্থীদের নিষ্ঠা ও ভক্তিকেই প্রকাশ করে।
উৎসব আয়োজন ও পবিত্রতার সংকল্প
রাস উৎসব উদ্যাপন কমিটি এবং দুবলার চর ফিশারম্যান গ্রুপের সভাপতি কামাল উদ্দিন নিশ্চিত করেছেন যে, তিথি অনুযায়ী আজ থেকেই পূজার্চনা শুরু হবে। এই আয়োজন মূলত বিশ্বাস, ঐতিহ্য এবং প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধার এক মেলবন্ধন। সুন্দরবনের মোহনায় এই রাস উৎসব প্রতি বছরই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে, যেখানে তারা প্রাকৃতিক পরিবেশে আধ্যাত্মিকতার গভীরতা অনুভব করার সুযোগ পান।
