গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা। এই মৌলিক শর্ত ব্যতিরেকে গণতন্ত্র কেবলই একটি অর্থহীন ধারণা, যেন জীর্ণশীর্ণ এক জমিদার বাড়ির ভগ্নদশা, যা কেবল তার অতীতের স্মৃতিচিহ্ন বহন করে কিন্তু কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। সম্প্রতি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে রাষ্ট্রপক্ষের দ্বিতীয় দিনের শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান এই জোরালো মন্তব্য করেন, যা দেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক প্রেক্ষাপটে নতুন করে আলোচনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে অনুষ্ঠিত এই গুরুত্বপূর্ণ শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সংবিধানের মৌলিক কাঠামো প্রসঙ্গেও তার অবস্থান পরিষ্কার করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, গণতন্ত্রকে সুসংহত করার লক্ষ্যে সংবিধানে যেকোনো প্রকার পদক্ষেপ বা সংস্কার গ্রহণ করা হলে তা দেশের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী হবে না। তার এই যুক্তি সাংবিধানিক ব্যাখ্যার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে, যা গণতন্ত্রের স্বার্থে প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধনের বৈধতাকে সমর্থন করে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের সিদ্ধান্ত: ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ভ্রান্তপ্রসূত’
অ্যাটর্নি জেনারেল তার যুক্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পূর্ববর্তী আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তকেও কড়া সমালোচনার মুখে ফেলেন। তিনি এটিকে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ভ্রান্তপ্রসূত’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এই মন্তব্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তার পক্ষ থেকে বিচারিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এক বিরল ও তাৎপর্যপূর্ণ সমালোচনা, যা দেশের আইনি অঙ্গনে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
এর আগে বুধবার, অর্থাৎ প্রথম দিনের শুনানিতেও অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান একই বিষয়ে কঠোর মন্তব্য করেন। তিনি সে সময় বলেছিলেন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার ফলেই দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং সামগ্রিকভাবে গণতন্ত্রের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। তার মতে, এই বাতিলের ফলে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হয়েছে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
রাজনৈতিক বিদ্বেষ ও গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার
বুধবারের শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল আরও অভিযোগ করেন যে, রাজনৈতিক বিদ্বেষমূলকভাবে আওয়ামী লীগকে সুবিধা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছিল। তার এই অভিযোগ দেশের রাজনৈতিক মহলে তীব্র আলোচনার জন্ম দিয়েছে, যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিতর্ক দীর্ঘদিনের পুরনো। তিনি দৃঢ়ভাবে আপিল বিভাগকে জানান যে, গণতন্ত্রের স্বার্থে এবং একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে আবারও দেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরি।
উল্লেখ্য, অ্যাটর্নি জেনারেলের এই দাবির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বিএনপি, জামায়াত ও সুজনসহ দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও আইনজীবীরাও এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের পক্ষে তাদের আইনগত যুক্তি ও বক্তব্য তুলে ধরেছেন। এই বহুমুখী সমর্থন ইঙ্গিত দেয় যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিষয়টি কেবল একটি আইনি বিতর্ক নয়, বরং এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্র ও নির্বাচনী ব্যবস্থার জন্য একটি মৌলিক ও অপরিহার্য প্রশ্ন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই আপিলের চূড়ান্ত রায় দেশের রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
