একসময় বই ছিল মানুষের জ্ঞানচর্চা, বিনোদন ও মননশীলতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু দ্রুত পরিবর্তনশীল বর্তমান বিশ্বে, যেখানে ডিজিটাল বিপ্লব প্রতিনিয়ত নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে, সেখানে ঐতিহ্যবাহী বই পড়ার সংস্কৃতি যেন ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে। এককালে পাঠকদের পদচারণায় মুখরিত জিনাত বুক স্টোর কিংবা সাগর পাবলিশার্সের মতো ঐতিহ্যবাহী বইয়ের দোকানগুলোর বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং অমর একুশে বইমেলায় বিক্রির হার ক্রমাগত হ্রাস পাওয়া, বাংলাদেশের পড়ুয়াদের বইবিমুখ হওয়ার এক উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরছে। এই ধারা শুধু প্রকাশনা শিল্পের ওপরই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে না, বরং দেশের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতেও এক গভীর শূন্যতার সৃষ্টি করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
বইপ্রেমীদের হারানো ঠিকানা: অতীত ও বর্তমান
রাজধানীর নিউমার্কেটের জিনাত বুক স্টোর, যা একসময় বইপ্রেমীদের কাছে একটি পরম পছন্দের স্থান ছিল, আজ সেখানে ঝাঁ-চকচকে মনোহারি দোকানের ভিড়। বইয়ের সুবাস আর পৃষ্ঠার মরমর ধ্বনির বদলে এখন সেখানে আধুনিক পণ্যের জৌলুস। একইরকমভাবে, বেইলি রোডের নাটক সরণির সাগর পাবলিশার্স, যেটি ছিল বইপ্রেমীদের আরেকটি তীর্থস্থান, সেটিও বছর দুয়েক হলো তাদের দরজায় তালা লাগিয়েছে। এই ঘটনাগুলো কেবল কয়েকটি দোকানের বন্ধ হয়ে যাওয়া নয়, বরং এটি একটি বৃহৎ পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবি – যেখানে কাগজের বইয়ের জায়গা দখল করে নিচ্ছে নতুনত্বের হাতছানি। দেশের সবচেয়ে বড় বই উৎসব, অমর একুশে বইমেলাতেও বেচাকেনার চিত্র এখন নিম্নমুখী। এমন এক অনিশ্চয়তার মুখে সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশনীগুলো তাদের নতুন বই প্রকাশের সংখ্যা কমিয়ে আনতে বাধ্য হচ্ছে, যা সামগ্রিকভাবে প্রকাশনা শিল্পে এক স্থবিরতা নিয়ে এসেছে। বিভিন্ন পাবলিক লাইব্রেরিতেও পাঠকখরার চিত্র একইরকম উদ্বেগজনক।
গভীরতর বিশ্লেষণ: পাঠবিমুখতার কারণ ও পরিণতি
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে পরিচালিত একটি বিস্তারিত অনুসন্ধানে বাংলাদেশের পাঠকদের বইবিমুখ হওয়ার এই করুণ চিত্রটি উঠে এসেছে। এই গবেষণায় সৃজনশীল ১০টি প্রকাশনীর কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন বয়সের ৩৫ জন পাঠকের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও, গত পাঁচ বছরে অমর একুশে বইমেলার বিক্রির হিসাব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করা হয়েছে, যা এই সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা দিয়েছে।
প্রযুক্তির প্রভাব ও পাঠ অভ্যাসের পরিবর্তন
সংশ্লিষ্টদের অনেকেই এই পরিবর্তনের জন্য প্রযুক্তির আশীর্বাদ ও অভিশাপ উভয়কেই দায়ী করছেন। স্মার্টফোন, ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহজলভ্যতা মানুষের সময় ও মনোযোগের একটি বড় অংশ কেড়ে নিচ্ছে। ফলে, বই পড়ার জন্য যে গভীর মনোযোগ এবং সময় ব্যয় প্রয়োজন, তা ক্রমশ বিরল হয়ে উঠছে। যদিও প্রযুক্তির কল্যাণে ই-বুক, অডিওবুক এবং অনলাইন আর্টিকেলের মাধ্যমে পাঠের বিষয়বস্তু ও ধরনে পরিবর্তন এসেছে, তবুও কাগজের বইয়ের প্রতি যে চিরাচরিত ভালোবাসা ও আকর্ষণ ছিল, তা এখন অনেকখানি ম্লান।
ফিকশন থেকে নন-ফিকশনে পাঠকদের ঝোঁক
অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, বর্তমান পাঠকেরা কল্পকাহিনি বা ফিকশনের বদলে নন-ফিকশন বইয়ের দিকে বেশি ঝুঁকছেন। এর কারণ হতে পারে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ব্যবহারিক জ্ঞান, আত্ম-উন্নয়ন এবং সমসাময়িক বিষয়গুলো সম্পর্কে জানার আগ্রহ বৃদ্ধি। একাডেমিক বা পেশাগত উন্নতির জন্য নন-ফিকশন বইয়ের চাহিদা বাড়লেও, এটি সাহিত্যের অন্যান্য শাখা, বিশেষ করে কল্পকাহিনিভিত্তিক সাহিত্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
প্রকাশকদের ভূমিকা ও গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের অভাব
সাহিত্যানুরাগীরা আরও মনে করেন, পাঠকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ও মানসম্মত বই তুলে ধরতে প্রকাশনীগুলো ব্যর্থ হচ্ছে। বাজার গবেষণা এবং পাঠকের চাহিদা অনুধাবনে ঘাটতির কারণে অনেক সময় এমন বই প্রকাশিত হচ্ছে, যা পাঠকের আগ্রহ জাগাতে পারছে না। এর ফলে, একসময়কার বইপাগল পাঠকসমাজ ক্রমান্বয়ে বই থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এই পাঠবিমুখতার দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল হিসেবে সমাজে অসংবেদনশীলতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সংকীর্ণতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে, যা একটি সভ্য সমাজের জন্য অশনিসংকেত বটে।
বিক্রি প্রায় অর্ধেকে নেমেছে: বইমেলার প্রেক্ষাপট
প্রতিবছর আয়োজিত অমর একুশে বইমেলার বিক্রির হিসাব বাংলাদেশের বইবাজারের হালহকিকত এবং পাঠকদের রুচি ও পছন্দের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেয়। দেশের প্রায় ৩০০ সৃজনশীল প্রকাশনীর বেশিরভাগ বই এই মেলাকে কেন্দ্র করেই প্রকাশিত হয়। এটি শুধুমাত্র একটি বাণিজ্য মেলা নয়, বরং এটি বাঙালির সাংস্কৃতিক উৎসব এবং নতুন সাহিত্যের উন্মোচন ক্ষেত্র। কিন্তু বিগত বছরগুলোর চিত্র বলছে, বিক্রি প্রায় অর্ধেকে নেমেছে, যা প্রকাশনা শিল্পের জন্য এক বড় উদ্বেগের কারণ। এই সংখ্যাগত পতন স্পষ্টতই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, বই কেনার আগ্রহ এবং ক্ষমতা উভয়ই হ্রাস পেয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে এই শিল্পের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থান
বই পড়ার প্রবণতার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান আন্তর্জাতিক পরিসরেও অত্যন্ত দুর্বল। ২০২৪ সালে সিইও ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিনের জরিপ অনুযায়ী, বিশ্বের ১০২টি দেশের মধ্যে বই পড়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৭তম। এই পরিসংখ্যান অত্যন্ত হতাশাজনক, কারণ এটি নির্দেশ করে যে, আমাদের দেশের পাঠকেরা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় খুব কম বই পড়েন। এই জরিপ থেকে আরও জানা যায় যে, বাংলাদেশের একজন মানুষ বছরে গড়ে তিনটিরও কম বই পড়েন। এই সংখ্যাটি কেবল বৈশ্বিক গড় থেকে অনেক নিচে নয়, বরং এটি একটি জাতির জ্ঞানচর্চা ও মননশীলতার দৈন্যদশার প্রতীক। একটি জাতি যখন কম বই পড়ে, তখন তাদের মধ্যে চিন্তাশীলতা, সৃজনশীলতা এবং সংবেদনশীলতার অভাব দেখা দেয়, যা সমাজের সামগ্রিক অগ্রগতিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বই পড়াকে আবারও দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করা এখন সময়ের দাবি।
