দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ বাস্তবায়নকে ঘিরে চলমান মতানৈক্য নিরসনে এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের টেলিফোনে যোগাযোগ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। এই ফোনালাপের মূল উদ্দেশ্য ছিল, উভয় দলের মধ্যে বিদ্যমান ভিন্নমত দূর করে একটি সাধারণ ঐকমত্যে পৌঁছানো। এই উদ্যোগ বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে, যখন বিভিন্ন পক্ষ থেকে সংস্কার প্রস্তাবনা এবং তার বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে মতপার্থক্য তীব্র হচ্ছে।
ফোনালাপ ও বিএনপির অভ্যন্তরীণ আলোচনা
বৃহস্পতিবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের এই ফোনালাপের বিস্তারিত অবগত করেন। জানা গেছে, জামায়াত নেতা তাহের সাহেব আলোচনার টেবিলে বসার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এর প্রতিক্রিয়ায়, বিএনপির মহাসচিব তাঁর দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে নিবিড় পরামর্শের পর একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জামায়াতকে জানানোর কথা ব্যক্ত করেছেন। বিকেলে প্রথম আলো-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের নিজেও এই ফোনালাপের বিষয়টি নিশ্চিত করেন, যা আলোচনার পথ উন্মুক্ত করার ইঙ্গিত দেয়।
‘জুলাই জাতীয় সনদ’ ও বিরোধের মূল কারণ
‘জুলাই জাতীয় সনদ’ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে মতপার্থক্য নতুন নয়। গত ২৮ অক্টোবর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত একটি বিস্তারিত প্রস্তাব জমা দিয়েছিল। তবে, এই প্রস্তাবনার তফসিলে উল্লেখিত সনদের সঙ্গে গত ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষরিত মূল জুলাই সনদের বেশ কিছু অসংগতি রয়েছে বলে বিএনপি তাতে আপত্তি তুলেছে। এটি একটি গভীরতর মতানৈক্যের জন্ম দিয়েছে, যা সংস্কার প্রস্তাবনার সারবস্তু এবং তার আইনি কাঠামো উভয়কেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
গণভোটের সময়কাল নিয়ে ভিন্নমত
এই সনদের বাস্তবায়নকে ঘিরে আরেকটি প্রধান বিতর্ক হলো এর বৈধতা প্রদানকারী গণভোটের সময়কাল। বিএনপি মনে করে, সংসদ নির্বাচনের দিনই এই গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। তাদের যুক্তি হলো, এতে সময় ও সম্পদের সাশ্রয় হবে এবং ভোটারদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাবে। অপরদিকে, জামায়াতে ইসলামী সম্পূর্ণ ভিন্ন মত পোষণ করে। তারা চায়, প্রথমে গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদকে একটি আইনি ভিত্তি দেওয়া হোক, এবং তারপর সেই আইনি কাঠামোর আলোকেই জাতীয় নির্বাচন পরিচালিত হোক। এই মৌলিক পার্থক্য দুই দলের মধ্যে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোকে বেশ চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের আহ্বান ও সতর্কতা
এমন পরিস্থিতিতে, দেশের অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ‘জুলাই সনদ’ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে একটি সম্মিলিত সমাধানে পৌঁছানোর জন্য জোর আহ্বান জানিয়েছে। গত রোববার উপদেষ্টা পরিষদের এক গুরুত্বপূর্ণ সভা থেকে একটি সুস্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে: যদি রাজনৈতিক দলগুলো এক সপ্তাহের মধ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সরকার নিজের মতো করেই একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এই সতর্কতা মূলত দলগুলোকে দ্রুত একটি ঐকমত্যে পৌঁছানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করছে এবং চলমান অচলাবস্থা নিরসনে সরকারের দৃঢ় অবস্থানকে নির্দেশ করছে।
