এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের গতিপ্রকৃতিতে এক ভয়ঙ্কর পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। গত দুই দশক ধরে ডেঙ্গু মূলত বর্ষাকেন্দ্রিক একটি রোগ হিসেবে পরিচিত ছিল, যার সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার দেখা যেত জুলাই ও আগস্ট মাসে। তবে গত চার বছর ধরে এই চিরাচরিত চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। এখন ডেঙ্গুর সর্বোচ্চ সংক্রমণ ঘটছে অক্টোবর মাসে, আর মৃত্যু সবচেয়ে বেশি হচ্ছে প্রায় শীতের দোরগোড়ায় থাকা নভেম্বরে। এই মাসটি বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রাণঘাতী মাস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা রোগটির মোকাবিলায় নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
বদলে যাওয়া ডেঙ্গুর চিত্র: এক নতুন জনস্বাস্থ্য সংকট
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, বছরের শেষভাগে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পাওয়ার এই নতুন প্রবণতা দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় একটি গুরুতর সমস্যা যোগ করেছে। প্রখ্যাত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বে-নজির আহমেদ এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তার মতে, ডেঙ্গু মোকাবিলায় প্রচলিত এবং প্রথাগত চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে আসার সময় এসেছে। রোগের সংক্রমণ ও মৃত্যুর সময়ের এই নাটকীয় পরিবর্তনের সাথে সঙ্গতি রেখে ডেঙ্গু মোকাবিলার কৌশলও জরুরি ভিত্তিতে পরিবর্তন করা আবশ্যক। দুর্ভাগ্যবশত, সরকারি স্তরে এই নতুন বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে কৌশল প্রণয়নের ক্ষেত্রে এক ধরনের অনুপস্থিতি বা ধীরগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। প্রথাগত ধারণার ওপর নির্ভরতা এখন আর কার্যকর নয়, বরং প্রয়োজন একটি গতিশীল ও অভিযোজিত পরিকল্পনা।
নভেম্বরের ৭ দিনের ভয়ংকর পরিসংখ্যান
চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম সাত দিনের পরিসংখ্যান ডেঙ্গুর নতুন এবং মারাত্মক প্রবণতার এক সুস্পষ্ট চিত্র তুলে ধরেছে। এই সাত দিনে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২৯ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। চলতি বছরের এর আগের কোনো মাসে সাত দিনে এত বিপুল সংখ্যক রোগীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি, যা নভেম্বরের ভয়াবহতাকে আরও প্রকট করে তুলেছে। একই সময়ে, ৬ হাজার ৬৫২ জন রোগী ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, যা সংক্রমণের তীব্রতা নির্দেশ করে।
- অক্টোবর মাসকে চলতি বছরের সর্বোচ্চ ডেঙ্গু সংক্রমণের মাস হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও, নভেম্বরের প্রথম সাত দিনের সংক্রমণের সংখ্যা অক্টোবরের প্রথম সাত দিনের চেয়েও বেশি ছিল। অক্টোবরের প্রথম সাত দিনে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৬২ জন, যা নভেম্বরের ৬,৬৫২ জনের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। এটি প্রমাণ করে যে, সংক্রমণের তীব্রতা বছরের শেষ দিকে এসে আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
- গত বুধবার (৫ নভেম্বর) এক দিনে ১০ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, যা চলতি বছরে এক দিনে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যুর নতুন রেকর্ড। এই পরিসংখ্যান এক দিনে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা ও প্রাণঘাতী ক্ষমতাকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
- সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টার তথ্যে (বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুক্রবার সকাল আটটা পর্যন্ত) দেখা গেছে, এই সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৮৮ জন। স্বস্তির বিষয় এই যে, এই নির্দিষ্ট ২৪ ঘণ্টায় কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। তবে সামগ্রিক প্রবণতা বিবেচনা করলে এটি কোনো স্বস্তিদায়ক বার্তা নয়, বরং একটি বৃহত্তর সংকটের অংশ মাত্র।
বদলে যাওয়া ডেঙ্গু: প্রথাগত প্রতিরোধের অসারতা
ডেঙ্গুর এই নতুন প্যাটার্ন কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং বিশ্বজুড়ে উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এটি একটি বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য উদ্বেগ। তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং বৃষ্টিপাতের ধরন পরিবর্তনের ফলে এডিস মশার জীবনচক্র ও প্রজনন ক্ষমতা প্রভাবিত হচ্ছে, যা রোগের মৌসুমী প্রবণতাকে পরিবর্তন করছে। আগে যেখানে বর্ষার শুরুতেই মশার উপদ্রব চরম আকার ধারণ করত, এখন তা উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে বছরের শেষ ভাগেও সমানভাবে সক্রিয় থাকছে। এই পরিবর্তন ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রথাগত পদ্ধতি যেমন, কেবল বর্ষাকালে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান বা ফগার ব্যবহারের অসারতা প্রমাণ করছে। বছরজুড়েই ডেঙ্গু প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা এখন অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।
উপসংহারে বলা যায়, ডেঙ্গুর এই পরিবর্তিত চরিত্র মোকাবিলায় সরকার ও জনগণের সম্মিলিত এবং অভিযোজিত উদ্যোগ প্রয়োজন। সচেতনতা বৃদ্ধি, মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের নিরবচ্ছিন্ন অভিযান, দ্রুত রোগ নির্ণয় ও উন্নত চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি গবেষণা ও নীতি নির্ধারণে দূরদৃষ্টির পরিচয় দেওয়া অপরিহার্য। ডেঙ্গু এখন আর শুধু বর্ষার রোগ নয়, বরং এটি সারা বছরের একটি চ্যালেঞ্জ, যার জন্য প্রয়োজন সর্বাত্মক ও ধারাবাহিক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা।
