বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গনে এক নতুন বিতর্কের ঢেউ উঠেছে, যা নারী দলের সাবেক নির্বাচক ও ম্যানেজার মঞ্জুরুল ইসলামকে ঘিরে। জাতীয় নারী দলের তারকা ক্রিকেটার জাহানারা আলম তাঁর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মতো গুরুতর অভিযোগ এনেছেন। সম্প্রতি একটি ইউটিউব চ্যানেলে দেওয়া এক বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারে জাহানারা এই অভিযোগ তুলেছেন, যা ক্রীড়ামহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
জাহানারার অভিযোগ অনুযায়ী, মঞ্জুরুল ইসলাম নারী দলের ক্রিকেটারদের প্রতি ‘মন্দ স্পর্শ’ করতেন, যা একজন পেশাদার কর্মকর্তা হিসেবে সম্পূর্ণ অনৈতিক ও আপত্তিজনক। এছাড়াও, তিনি নাকি ক্রিকেটারদের কাছ থেকে স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত অত্যন্ত ব্যক্তিগত ও সংবেদনশীল তথ্য জানতে চাইতেন, যা সাধারণত দলের ফিজিওর একচ্ছত্র দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। জাহানারার দাবি, এই ধরনের প্রশ্ন তাঁকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অস্বস্তিতে ফেলেছিল।
জাহানারার অভিযোগের পরিধি এবং নীরবতা
অভিযোগ শুধু মঞ্জুরুল ইসলামকেই ঘিরে নয়; জাহানারা আলম তাঁর ক্যারিয়ার ‘ধ্বংস করে দেওয়ার’ চেষ্টা করার জন্য আরও বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। বিশেষত, ২০২১ সাল থেকে পরবর্তী দেড় বছর ধরে ঘটে যাওয়া এই সমস্ত ঘটনা তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) এবং নারী উইংয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নজরে এনেছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, জাতীয় দলের সাবেক এই অলরাউন্ডার বারবার অবগত করা সত্ত্বেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ বা প্রতিকার পাননি বলে জানিয়েছেন। এটি বিসিবির অভ্যন্তরীণ তত্ত্বাবধান এবং অভিযোগ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
মঞ্জুরুল ইসলামের কর্মজীবন ও বর্তমান অবস্থান
অভিযুক্ত মঞ্জুরুল ইসলাম বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গনে একটি পরিচিত নাম। ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনি জাতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলের হয়ে ১৭টি টেস্ট এবং ৩৪টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণের পর এই সাবেক বাঁহাতি পেসার বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)-এর অধীনে বিভিন্ন দলের কোচিং ও ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০২০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তিনি জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের নির্বাচকের দায়িত্বে ছিলেন এবং একই সময়ে বিভিন্ন সিরিজে দলের ম্যানেজার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। বর্তমানে তিনি চীনে নারী ক্রিকেট দলের প্রধান কোচ হিসেবে কাজ করছেন, যা তাঁর দীর্ঘ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ ক্রিকেট কর্মজীবনেরই অংশ।
অভিযোগ অস্বীকার ও তদন্তের মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আজ মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে মঞ্জুরুল ইসলাম জাহানারা আলমের সমস্ত অভিযোগ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি এই অভিযোগগুলোকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা আখ্যা দিয়েছেন। নিজের নির্দোষিতা প্রমাণের জন্য তিনি দেশে এসে যেকোনো তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হতেও প্রস্তুত আছেন বলে জানিয়েছেন। এটি নিঃসন্দেহে এই বিতর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়, যা একটি নিরপেক্ষ ও পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের পথ খুলে দেবে।
ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য তথ্যের বিষয়ে ভিন্ন মত
জাহানারা তাঁর সাক্ষাৎকারে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন যে, মঞ্জুরুল তাঁর কাছে নারী স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য সম্পর্কে জানতে চাইতেন, যা সাধারণত দলের ফিজিওর জানার কথা এবং শুধুমাত্র চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রয়োজনে। এই বিষয়ে মঞ্জুরুল ইসলাম পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলেছেন যে, দলের ম্যানেজার হিসেবে তিনি ফিজিওর মাধ্যমেই এসব তথ্য পেতেন এবং এটি তাঁর পেশাগত দায়িত্বের অংশ ছিল, ব্যক্তিগত কৌতূহলের বিষয় ছিল না। এই তথ্যের আদান-প্রদান দলের খেলোয়াড়দের স্বাস্থ্য ও পারফরম্যান্স ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় হতে পারে, তবে এর সীমা ও পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এই গুরুতর অভিযোগগুলো বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটের পরিবেশ এবং খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিসিবির উচিত দ্রুত একটি নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্তের মাধ্যমে সত্য উদ্ঘাটন করা এবং এই ধরনের অভিযোগের পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে নারী ক্রিকেটাররা নির্ভয়ে এবং নিরাপদে তাঁদের খেলা চালিয়ে যেতে পারেন।
