পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতালের সামনে এক চাঞ্চল্যকর গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। প্রকাশ্য দিবালোকে সংঘটিত এই সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত ব্যক্তির বিস্তারিত পরিচয় এখন জনসমক্ষে এসেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছে যে, নিহত ব্যক্তিটি হলেন তারিক সাঈফ মামুন (৫৫), যিনি দেশের অপরাধ জগতে শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এই ঘটনা রাজধানীতে আবারো অপরাধীদের বেপরোয়া তত্পরতার চিত্র তুলে ধরেছে, যা জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা: বিবরণ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য
গতকাল সোমবার সকাল আনুমানিক সাড়ে ১০টার দিকে এই নৃশংস ঘটনা ঘটে। হাসপাতালের ঠিক সামনেই গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মামুনকে লুটিয়ে পড়তে দেখা যায়। ঘটনাস্থলের প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রাথমিক পুলিশি তদন্তে জানা যায়, দুর্বৃত্তরা অত্যন্ত কাছ থেকে তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়, যা তার বাঁচার কোনো সুযোগই রাখেনি। এই নির্লজ্জ হামলা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সংঘটিত হয় এবং হামলাকারীরা নির্বিঘ্নে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে, যা তাদের দুঃসাহস ও পরিকল্পনার গভীরতা নির্দেশ করে।
অপরাধ জগতের দীর্ঘদিনের রেষারেষি: মূল কারণ
পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নিহত মামুন একসময় আরেক কুখ্যাত শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। তবে, অপরাধ সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তাদের দুজনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই তীব্র বিরোধ চলে আসছিল। এই বিরোধ ক্রমেই এতটাই তিক্ত হয়ে ওঠে যে, অনেকেই আশঙ্কা করছিলেন এমন একটি সহিংস পরিণতির। ধারণা করা হচ্ছে, এই পূর্ব শত্রুতার জের ধরেই মামুনের উপর এই প্রাণঘাতী হামলা চালানো হয়েছে।
সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়ল লোমহর্ষক দৃশ্য
গুলির ঘটনার একটি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার (সিসিটিভি) ভিডিও ফুটেজ প্রথম আলোর হাতে এসে পৌঁছেছে, যা এই হামলার নির্মমতা ও সুপরিকল্পিত প্রকৃতি স্পষ্ট করে। ফুটেজে দেখা যায়, মামুন নিজের জীবন বাঁচাতে দ্রুত দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করছেন। ঠিক সেই মুহূর্তে, দুজন আততায়ী খুব কাছ থেকে তাকে লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে। পুরো ঘটনাটি মাত্র ৩ থেকে ৪ সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে যায়। গুলি চালানোর পর, হামলাকারীরা কোনো তাড়াহুড়ো না করে স্বাভাবিক গতিতে হেঁটে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে, যা তাদের পেশাদারিত্ব এবং নির্ভীকতা নির্দেশ করে। এই দৃশ্য সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
পরিবারের দাবি ও ইমনের জড়িত থাকার সন্দেহ
নিহত মামুনের পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, তিনি গত দুই বছর ধরে রাজধানীর বাড্ডা এলাকার একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করছিলেন। ঘটনার দিন সকালে তার একটি মামলায় আদালতে হাজিরা দেওয়ার কথা ছিল। এ কারণেই তিনি বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। মামুনের স্ত্রী, বিলকিস আক্তার, প্রথম আলোকে জানিয়েছেন যে, তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের লোকজনই জড়িত। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, এর আগেও ইমনের লোকেরা মামুনকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল, যা তাদের দীর্ঘদিনের শত্রুতার প্রমাণ।
ইমন-মামুন বাহিনী: এক সময়ের আতঙ্কের প্রতিচ্ছবি
পুলিশের দেওয়া তথ্যে আরও জানা যায় যে, শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন ও মামুন একসময় ঢাকার হাজারীবাগ, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর এবং তেজগাঁও এলাকার একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন। তাদের সম্মিলিত বাহিনী ‘ইমন-মামুন’ বাহিনী নামে পরিচিত ছিল এবং এই এলাকাগুলোতে তাদের ত্রাসে জনজীবন অতিষ্ঠ ছিল। তারা দুজনই চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলা এবং সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই সাঈদ আহমেদ টিপু হত্যা মামলার অন্যতম প্রধান আসামি। জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য অনুযায়ী, নিহত মামুনের পৈতৃক নিবাস লক্ষ্মীপুর জেলায় ছিল। তাদের অপরাধের দীর্ঘ ইতিহাস এবং উচ্চ প্রোফাইল মামলাগুলোতে তাদের সংশ্লিষ্টতা এই হত্যাকাণ্ডের গভীরতা এবং জটিলতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
