টেস্ট ক্রিকেটের অভিজাত অঙ্গনে বাংলাদেশের পথচলার পঁচিশ বছর পূর্ণ হলো সম্প্রতি। এক গৌরবময় রজতজয়ন্তী, যা শুরুর প্রাক্কালে স্বপ্ন দেখেছিল বিশ্বসেরা দলগুলোর কাতারে নিজেদের স্থান করে নেওয়ার। দীর্ঘ এই পথপরিক্রমায় প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির হিসাব-নিকাশে এখন বাস্তবের কঠিন জমিনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। এই বিশেষ মুহূর্তে সাবেক অধিনায়কেরা ফিরে দেখছেন অতীতের স্মৃতি, মূল্যায়ন করছেন বর্তমানের বাস্তবতা এবং একইসাথে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছেন গভীর চিন্তায়। তাদের বিশ্লেষণ আমাদের সামনে তুলে ধরে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থান এবং আগামীর পথরেখা কেমন হওয়া উচিত।
স্বপ্ন ও বাস্তবতার ফারাক: ২৫ বছরের টেস্ট ক্রিকেট
যখন বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা লাভ করে, তখন দেশের ক্রিকেটপ্রেমী থেকে শুরু করে খেলোয়াড় ও বোর্ডের কর্তাব্যক্তিদের চোখে ছিল এক অপার স্বপ্ন—টেস্ট ক্রিকেটের পরাশক্তিগুলোর অন্যতম হয়ে ওঠা। পঁচিশ বছর পেরিয়ে এসে সেই স্বপ্ন কতটুকু পূরণ হয়েছে, তা এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন হিসেবেই রয়ে গেছে। সাবেক জাতীয় দলের অধিনায়ক আকরাম খান খোলাখুলি বলেছেন, “আমরা যখন প্রথম টেস্ট খেলেছিলাম, স্বপ্ন দেখেছিলাম টেস্টে সেরা চার দলের একটি হব। সেই আশা পূরণ হয়নি, এটা বলা বাহুল্য। অন্য টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশ এগোতে পারেনি।” তার এই পর্যবেক্ষণ টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের অগ্রগতির শ্লথ গতি এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পিছিয়ে পড়ার এক স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরে।
সুযোগ-সুবিধার উন্নতি বনাম পারফরম্যান্সের স্থবিরতা
টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার শুরুর দিনগুলোতে বাংলাদেশের ক্রিকেটের অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ছিল চোখে পড়ার মতো। আকরাম খান স্মৃতিচারণ করে বলেন, “টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার সময় নিজেদের কোনো মাঠই ছিল না। অনুশীলনের সুযোগ-সুবিধাও ছিল না।” কিন্তু সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমানে দেশজুড়ে অসংখ্য ক্রিকেট মাঠ রয়েছে, খেলোয়াড়েরা পাচ্ছেন আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা। আর্থিকভাবেও তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বাবলম্বী ও সুরক্ষিত। ক্রিকেট এখন কেবল একটি খেলা নয়, অনেক ক্রিকেটারের জন্য এটি একটি সম্মানজনক পেশাও বটে।
কিন্তু এই ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সুযোগ-সুবিধার বিস্তার কি পারফরম্যান্সে কাঙ্ক্ষিত প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছে? আকরাম খানের মতে, উত্তরটি নেতিবাচক। তিনি হতাশার সাথে উল্লেখ করেন, “এখন অনেক মাঠ, খেলোয়াড়েরা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। আর্থিকভাবেও তাঁরা স্বাবলম্বী। কিন্তু আমরা ওই পর্যায়ে যেতে পারিনি।” এটি একটি গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করে: শুধুমাত্র সুযোগ-সুবিধা বাড়ালেই কি সাফল্যের শিখরে পৌঁছানো সম্ভব, নাকি এর জন্য আরও গভীর কিছু প্রয়োজন?
খেলোয়াড়দের মানসিকতা: “অল্পতেই সন্তুষ্ট, অল্পতেই হৃদয় ভাঙে”
সাবেক অধিনায়ক আকরাম খানের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের মানসিকতা নিয়ে। তার মতে, “বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের আরেকটা সমস্যা হলো—ওরা অল্পতেই সন্তুষ্ট হয়ে যায়, আবার অল্পতেই তাঁদের হৃদয় ভেঙে যায়।” এই উক্তিটি গভীরভাবে চিন্তা করার মতো। এটি বোঝায় যে, খেলোয়াড়দের মধ্যে হয়তো দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রাম করে শীর্ষ পর্যায়ে টিকে থাকার বা নিজেদের আরও উন্নত করার প্রবল আকাঙ্ক্ষার অভাব রয়েছে। একটি ছোট জয় বা সামান্য ভালো পারফরম্যান্সেই তারা তৃপ্ত হয়ে যান, আবার সামান্য ব্যর্থতা বা প্রতিকূলতা এলেই তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এই মানসিকতা আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটের উচ্চ চাপের পরিবেশে টিকে থাকার জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে প্রতিটি দলই দীর্ঘ লড়াই এবং কঠিন মানসিকতার পরীক্ষা দিয়ে যায়, সেখানে এই ধরনের মানসিকতা নিয়ে সফল হওয়া অত্যন্ত কঠিন।
ব্যক্তিগত অর্জন বনাম দলগত ব্যর্থতা
বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের গত পঁচিশ বছরে নিঃসন্দেহে কিছু অসাধারণ ব্যক্তিগত প্রতিভার জন্ম হয়েছে। সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মাশরাফি বিন মুর্তজা, মোহাম্মদ আশরাফুল, মুশফিকুর রহিম, মুমিনুল হক—এমন অনেক নাম উঠে এসেছে যারা ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করেছেন। মুশফিকুর রহিম তো তার দৃঢ়তা ও অভিজ্ঞতার কারণে ১০০ টেস্ট খেলার মাইলফলক স্পর্শ করার পথে রয়েছেন। আকরাম খানও এই ব্যক্তিগত অর্জনের স্বীকৃতি দেন, “ব্যক্তিগতভাবে অনেকের অনেক অর্জন—সাকিব, তামিম, মাশরাফি, আশরাফুল, মুশফিক, মুমিনুল। মুশফিক তো সব ঠিক থাকলে ১০০ টেস্টও খেলবে।”
তবে, এই ব্যক্তিগত উজ্জ্বলতা সত্ত্বেও, দল হিসেবে বাংলাদেশের সাফল্য এখনও অধরা। টেস্ট ক্রিকেটে দলগত পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা এবং জয়ের হার এখনো আশানুরূপ নয়। আকরাম খানের সরাসরি মন্তব্য, “কিন্তু দল হিসেবে আমরা সাফল্য পাইনি।” এটি দেশের টেস্ট ক্রিকেটের এক বড় বৈপরীত্যকে তুলে ধরে—ব্যক্তিগত প্রতিভার ঝলকানি থাকলেও, একটি শক্তিশালী ও জয়ী দল হিসেবে বাংলাদেশ নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।
দলগত ব্যর্থতার মূল কারণ: সব স্তরে সমন্বয়ের অভাব
দলের এই ব্যর্থতাকে আকরাম খান ব্যক্তিগত বা কোনো এক বিশেষ দিকের ঘাটতি হিসেবে দেখেন না, বরং এটিকে তিনি সামষ্টিক ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তার মতে, “এই ব্যর্থতা আমাদের সবার। সব জায়গা থেকে যে সাহায্য আসা দরকার ছিল, তা আসেনি।” এর মধ্যে ক্রিকেট বোর্ডের ভূমিকা, জেলা পর্যায়ের ক্রিকেট এবং ঘরোয়া ক্রিকেটের মান অন্যতম।
ক্রিকেট বোর্ড ও জেলা পর্যায়ের খেলার ভূমিকা
ক্রিকেট বোর্ডের উন্নয়নের সক্ষমতা থাকলেও, তাদের নিয়ন্ত্রণ জেলা পর্যায়ের খেলায় ততটা ছিল না। আকরাম খান স্বীকার করেন, “ক্রিকেট বোর্ড উন্নয়ন করতে পারত, এটা ঠিক। কিন্তু জেলার খেলায় বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ নেই।” জেলা ক্রিকেট হলো ভবিষ্যতের খেলোয়াড় তৈরির আঁতুড়ঘর। এই স্তরে সঠিক তত্ত্বাবধান, ভালো সুযোগ-সুবিধা এবং মানসম্পন্ন প্রতিযোগিতা না থাকলে দীর্ঘমেয়াদী প্রতিভার ঘাটতি সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক।
ঘরোয়া ক্রিকেটের দুর্বলতা: ভিত্তিহীন কাঠামো
বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের দুর্বলতার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে আকরাম খান ঘরোয়া ক্রিকেটের মানকে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, “ভালো সুযোগ-সুবিধা, ভালো উইকেটে খেলা, নিয়মিত লিগ আয়োজন এসবের ঘাটতি ছিল। ঘরোয়া ক্রিকেটের মান এখনো অনেক কম।” আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটের জন্য যে ধরনের মেধা ও মননশীলতা প্রয়োজন, তা তৈরি হয় একটি শক্তিশালী ঘরোয়া কাঠামো থেকে। যেখানে ভালো মানের পিচ নেই, নিয়মিত লিগ হয় না এবং প্রতিযোগিতার অভাব থাকে, সেখানে আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় তৈরি হওয়া কঠিন। ঘরোয়া ক্রিকেটে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা, মানসম্পন্ন বোলারদের মোকাবেলা এবং দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাটিং বা বোলিং করার সুযোগ না পেলে খেলোয়াড়েরা টেস্ট ক্রিকেটের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হতে পারেন না।
খেলোয়াড়দের উচ্চাকাঙ্ক্ষার অভাব
আকরাম খান আরও একটি কড়া সত্য তুলে ধরেছেন: “ভালো পর্যায়ে যাওয়ার স্বপ্ন খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিল না।” অনেক খেলোয়াড় হয়তো সুযোগ-সুবিধার অভাবকে তাদের ভালো খেলোয়াড় না হওয়ার কারণ হিসেবে দাঁড় করান। কিন্তু আকরাম খান এই যুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “কিন্তু আরও ১০-১৫ বছর আগে কম সুযোগ-সুবিধা নিয়েও সাকিবের মানের খেলোয়াড় বের হয়েছে।” এটি প্রমাণ করে যে, সুযোগ-সুবিধা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো খেলোয়াড়দের ভেতরের তাগিদ, শেখার আগ্রহ এবং নিজেদের সেরা করে তোলার প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষা। সাকিব আল হাসানের মতো ব্যতিক্রমী প্রতিভারা প্রতিকূল পরিবেশেও নিজেদের প্রমাণ করতে পেরেছেন, যা বাকিদের জন্য এক বড় অনুপ্রেরণা হওয়া উচিত।
