জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বহুল আলোচিত মামলার রায় ঘোষণার দিন রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বর এলাকা সোমবার দিনভর ছিল চরম উত্তপ্ত। এদিন একদল উত্তেজিত বিক্ষোভকারী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত বাসভবন ভাঙচুরের অপচেষ্টা চালায়। তাদের এই বিধ্বংসী অভিপ্রায় প্রতিহত করতে তাৎক্ষণিকভাবে সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে কড়া প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, যা পরবর্তীতে দফায় দফায় সংঘর্ষের জন্ম দেয়। এই তীব্র অস্থিরতার কারণে সংলগ্ন মিরপুর সড়কে যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়, সৃষ্টি হয় ব্যাপক জনদুর্ভোগ। তবে দীর্ঘক্ষণ ধরে চলা এই সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি অবশেষে সন্ধ্যার পর শান্ত হতে শুরু করে এবং রাত নামার সাথে সাথে পরিস্থিতি স্বাভাবিকের দিকে এগোয়।
সংঘর্ষ ও নিরাপত্তা বাহিনীর দৃঢ় অবস্থান
মানবতাবিরোধী অপরাধের রায়কে কেন্দ্র করে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের মতো একটি সংবেদনশীল এলাকায় এমন বিক্ষোভের ঘটনায় দ্রুতই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তৎপর হয়ে ওঠেন। বিক্ষোভকারীরা যখন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দিকে অগ্রসর হতে চেয়েছিল, তখন সেনাবাহিনী ও পুলিশ তাদের পথ রোধ করে। এ নিয়ে দিনভর উভয় পক্ষের মধ্যে ক্ষোভ ও উত্তেজনা ছড়াতে থাকে এবং একাধিকবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। নিরাপত্তা বাহিনী অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালিয়ে যায়। সংঘর্ষ চলাকালীন এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করে এবং পথচারী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
যান চলাচল স্বাভাবিককরণ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
দিনভর সংঘর্ষের পর অবশেষে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলে যান চলাচলের জন্য সড়কগুলো খুলে দেওয়া হয়। সোমবার রাত আটটার পর মিরপুর থেকে নিউমার্কেটগামী সড়কটি প্রথমে খুলে দেওয়া হয়, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে আনে। এর প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর, অর্থাৎ রাত সাড়ে ১০টার দিকে, নিউমার্কেট থেকে মিরপুরগামী সড়কটিও উন্মুক্ত করা হয়। এর ফলে দীর্ঘক্ষণ ধরে আটকে থাকা যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, মিরপুর সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হলেও ধানমন্ডি ৩২ নম্বর এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য সতর্ক অবস্থানে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনের সড়কে ছোট ছোট ইটের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়, যা দিনভর চলা সংঘর্ষের সাক্ষ্য বহন করছিল। তবে ঘটনাস্থলে আর কোনো বিক্ষোভকারীকে দেখা যায়নি। পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাত ১১টার দিকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের সড়কটি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া হয়। সড়কটির প্রবেশমুখে সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা কড়া পাহারা বসান এবং কাউকে এই পথ দিয়ে চলাচল করতে দেওয়া হচ্ছিল না। এছাড়া, সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়, যা পরিস্থিতির গুরুতর ইঙ্গিত দিচ্ছিল।
পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য ও চলমান সতর্কতা
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ধানমন্ডি অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার জিসানুল হক রাত ১১টার দিকে গণমাধ্যমকে জানান, “আমরা বিক্ষোভকারীদের সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি। বর্তমানে যান চলাচল শুরু হয়েছে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।” তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, রাতেও পুলিশের সতর্ক অবস্থান বজায় থাকবে, যাতে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা আর না ঘটে। এই মন্তব্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পেশাদারিত্ব ও চলমান সতর্কতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ঘটনার নেপথ্যে: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়
এই ব্যাপক বিক্ষোভ ও উত্তেজনার মূল কারণ ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি চাঞ্চল্যকর রায়। গতকাল, জুলাই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। এই কঠোর রায়ই সারাদেশে, বিশেষত রাজধানীতে, ব্যাপক অস্থিরতা এবং এই বিক্ষোভের জন্ম দেয়, যা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের মতো একটি ঐতিহাসিক স্থানে সংঘাতের রূপ নেয়।
