কার্তিক ও অগ্রহায়ণের এই সন্ধিক্ষণে, যখন বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী কক্সবাজার অঞ্চলে মৎস্য আহরণের ভরা মৌসুম তুঙ্গে থাকার কথা, তখন টেকনাফের উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে বিরাজ করছে এক ভিন্ন চিত্র। নভেম্বরের এই সময়টাতে জেলেরা ঐতিহ্যগতভাবে দলবদ্ধ হয়ে সাগর ও নদীতে মাছ ধরতে যেতেন, যা তাদের প্রাত্যহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু এ বছর মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) ভয়াবহ হুমকির কারণে প্রায় পাঁচ হাজার জেলে মৎস্য শিকারে বিরত থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। গভীর সমুদ্রে মাছের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও, আতঙ্কের হিমশীতল চাদরে ঢাকা পড়েছে তাদের জীবিকা।
মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠীর নীরব হুমকি
ভুক্তভোগী জেলেরা জানিয়েছেন, মিয়ানমার সীমান্তবর্তী নাফ নদী এবং সংলগ্ন সামুদ্রিক এলাকায় মৎস্য শিকারে নামলেই আরাকান আর্মির সদস্যরা ট্রলারসহ জেলেদের জিম্মি করে নিয়ে যাচ্ছে। গত মাসে তাদের তৎপরতা কিছুটা প্রশমিত থাকলেও, চলতি নভেম্বরে অপহরণের হার উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই মাসেই পৃথক পাঁচটি ঘটনায় মোট ২৯ জন জেলেকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি। এই একের পর এক ঘটনা জেলেপল্লিতে তীব্র আতঙ্ক ও গভীর দুশ্চিন্তা সৃষ্টি করেছে। মৎস্য আহরণের ভরা মৌসুমে জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস বন্ধ থাকায় অনেক পরিবার বর্তমানে চরম আর্থিক সংকটে নিমজ্জিত।
টেকনাফের কায়ুকখালী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি সাজেদ আহমেদ এই ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণ সাগরে ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের প্রাচুর্য রয়েছে। কিন্তু ট্রলার নিয়ে সেখানে গেলেই আরাকান আর্মি ধাওয়া করছে। মাঝেমধ্যে তারা গুলি ছুড়ে ট্রলারসহ জেলেদের জিম্মি করছে। এই নিরন্তর হয়রানি ও অপহরণের আতঙ্কে অন্তত পাঁচ হাজার জেলে সমুদ্রে মাছ ধরতে নামতে পারছেন না।”
অপহরণের একের পর এক ঘটনা
সর্বশেষ গত বুধবার ভোরে সেন্ট মার্টিনের ছেঁড়াদিয়া দ্বীপের দক্ষিণ দিক থেকে দুটি মাছ ধরার ট্রলারসহ দশ জন জেলেকে অপহরণ করে আরাকান আর্মি। এর আগের দিন মঙ্গলবার গভীর রাতে একই এলাকা থেকে একটি ট্রলার এবং ছয় জন জেলেকে জিম্মি করা হয়। চলতি মাসের ১২ নভেম্বর আরও ১৩ জন জেলেকে নিয়ে যায় এই সশস্ত্র গোষ্ঠী। গতকাল শনিবার পর্যন্ত এই ২৯ জন অপহৃত জেলের একজনকেও বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়নি, যা তাদের পরিবার ও স্বজনদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
নিশ্চল নৌযান ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা
সরেজমিনে দেখা গেছে, টেকনাফের কায়ুকখালী ঘাটেই প্রায় দুই শতাধিক মাছ ধরার ট্রলার অকর্মণ্য অবস্থায় নোঙর ফেলে আছে। একইসাথে উপজেলার শাহপরীর দ্বীপ, জালিয়াপাড়া, দক্ষিণপাড়া এবং ঘোলাপাড়ার ঘাটগুলোতেও শত শত ট্রলার অলসভাবে পড়ে আছে। এগুলো যেন শুধু কাঠ বা লোহা নয়, বরং হাজারো জেলে পরিবারের স্বপ্ন ও জীবিকার প্রতিচ্ছবি, যা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অপেক্ষায়। ভরা মৌসুমে এই অস্বাভাবিক স্থবিরতা জেলেদের জীবনযাত্রায় এক ভয়াবহ সংকট তৈরি করেছে, যা দ্রুত সমাধান না হলে তাদের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে।
