বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়, সশস্ত্র বাহিনী দিবস, শুক্রবার রাজধানী ঢাকার সেনাকুঞ্জে যথাযথ মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয়েছে। এই বিশেষ অনুষ্ঠানে দেশের শীর্ষস্থানীয় দুই ব্যক্তিত্ব, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, এক সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হন। এই অপ্রত্যাশিত সাক্ষাৎ রাজনৈতিক মহলে আলোচনার নতুন মাত্রা যোগ করেছে এবং উপস্থিত সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
সশস্ত্র বাহিনী দিবসের বর্ণাঢ্য আয়োজনে যোগ দিতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার আগেই তাঁর গুলশানের বাসভবন থেকে সেনাকুঞ্জের উদ্দেশে রওনা দেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি গাড়ি থেকে নেমে হুইলচেয়ারের সাহায্যে মূল অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করেন, যা সেখানে উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মী ও অতিথিদের মনোযোগ কাড়ে।
সশস্ত্র বাহিনী দিবস: এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ও অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্যে তিনি বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর জন্ম এবং মুক্তিযুদ্ধে তাদের অসামান্য অবদানের ওপর বিস্তারিত আলোকপাত করেন। অধ্যাপক ইউনূস অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলেন, ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী রণক্ষেত্রেই আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর গৌরবময় জন্ম। তিনি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করিয়ে দেন যে, ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক ও মরণপণ প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেছিল। এই সমন্বিত সামরিক অভিযান মুক্তিযুদ্ধের গতিপথ নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং প্রতি বছর এই দিনটিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক অবিস্মরণীয় মাইলফলক হিসেবে সগৌরবে স্মরণ করা হয়।
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর বক্তব্যে আরও উল্লেখ করেন যে, মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের সূচনা ঘটে ২৫ মার্চের সেই কালরাত্রি থেকেই। তিনি সেই ভয়াল সময়ের কথা স্মরণ করে বলেন, যদি স্বাধীনতার বিজয় অর্জিত না হতো, তবে এই অকুতোভয় বীর সেনানিদের পরিণতি ছিল নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ড, আর তাঁদের পরিবারগুলোর জীবন হয়ে উঠত অসহনীয় বিভীষিকাময়। অধ্যাপক ইউনূস দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেন যে, ’৭১ সালের ২১ নভেম্বরের এই ত্রিমাত্রিক যৌথ সামরিক অভিযানই ১৬ ডিসেম্বরের চূড়ান্ত বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল এবং দেশকে স্বাধীন করে এনেছিল। তিনি উপসংহার টেনে বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর এই আত্মত্যাগ ও বীরত্বের কাহিনি স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সর্বদা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে এবং সঠিক পথে চলার অনুপ্রেরণা যোগাবে।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি ও সৌজন্য সাক্ষাৎ
সেনাকুঞ্জে পৌঁছানোর পরপরই বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে একান্তে কিছুক্ষণের জন্য কথা বলেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় কয়েক মিনিট ধরে ফলপ্রসূ আলোচনা চলে। এরপর তাঁরা দুজনেই মূল অনুষ্ঠানস্থলে যান এবং সেখানে পাশাপাশি আসনে উপবিষ্ট হন। অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে প্রধান উপদেষ্টা এবং বিএনপির চেয়ারপারসনকে অত্যন্ত হাসিমুখে আলাপচারিতায় মগ্ন থাকতে দেখা যায়, যা সেখানে এক সৌহার্দ্যপূর্ণ এবং ইতিবাচক পরিবেশের ইঙ্গিত দেয়। উল্লেখ্য, বিগত এক বছর পর আবারও সশস্ত্র বাহিনী দিবসের এই ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন।
এই সাক্ষাৎকালে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেন। তিনি তাঁর দ্রুত আরোগ্য লাভ এবং দীর্ঘ ও সুস্থ জীবন কামনা করেন, যা তাঁদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সামাজিক শিষ্টাচারের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
