মিরপুরের শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামে রেফারির শেষ বাঁশি বাজার সাথে সাথেই গ্যালারির বাঁধভাঙা উল্লাসের মাঝে শুরু হলো এক ঐতিহাসিক উৎসব। কোর্টের চারপাশে লাল-সবুজ পতাকা হাতে নিয়ে ছুটছেন রুপালি-বৃষ্টিরা, দর্শকদের অভিবাদনের জবাব দিচ্ছেন হাসিমুখে। কারণ, এই প্রথম বাংলাদেশ নারী কাবাডি দল নারী কাবাডি বিশ্বকাপের মঞ্চে অন্তত একটি ব্রোঞ্জ পদক নিশ্চিত করার গৌরব অর্জন করেছে। এটি কেবল একটি পদকপ্রাপ্তি নয়, এটি বাংলাদেশের নারী কাবাডিতে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন, যা বহু দিনের কঠোর পরিশ্রম ও স্বপ্নের সফল পরিণতি।
থাইল্যান্ড বধ করে সেমিফাইনালের টিকিট
আজ এক শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে বাংলাদেশ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী থাইল্যান্ডকে ৪০-৩১ পয়েন্টের ব্যবধানে পরাজিত করে সেমিফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করেছে। এই জয়ের মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক কাবাডির নিয়ম অনুযায়ী, সেমিফাইনালে হারলেও অংশগ্রহণকারী দল ব্রোঞ্জ পদক লাভ করে থাকে; ফলে বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক পদকটি নিশ্চিত হয়ে যায়। ম্যাচের শুরু থেকেই দুই দলের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যায়, যেখানে প্রতি মুহূর্তেই পাল্টাপাল্টি আক্রমণের মাধ্যমে দর্শকরাও যেন খেলার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিলেন।
শ্রাবণীর চোট ও বীরোচিত প্রত্যাবর্তন
ম্যাচের প্রথমার্ধে বাংলাদেশ দারুণ লড়াই চালিয়ে গেলেও, এক উদ্বেগজনক মুহূর্ত সৃষ্টি হয় যখন দলের অন্যতম রেইডার শ্রাবণী মল্লিক চোট নিয়ে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন। গ্যালারিতে উপস্থিত স্বাগতিক দর্শকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে, তবে কয়েক মিনিট পরই শ্রাবণী সুস্থ হয়ে মাঠে ফিরে আসেন। তার এই প্রত্যাবর্তন শুধু দলের মনোবলই বাড়ায়নি, বিরতির ঠিক আগে তার একটি সফল রেইড থেকে ২ পয়েন্ট অর্জন বাংলাদেশকে ১৪-১২ পয়েন্টের ব্যবধানে এগিয়ে দেয়, যা প্রথমার্ধ শেষে এক সুস্পষ্ট মানসিক সুবিধা এনে দেয়।
দ্বিতীয়ার্ধে যেন এক ভিন্ন শ্রাবণীকে দেখা যায়। প্রথমার্ধের চোটের সমস্যা কাটিয়ে তিনি আরও বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন। একের পর এক সফল রেইড দিয়ে তিনি বাংলাদেশের পয়েন্টের ব্যবধান বাড়িয়ে যেতে থাকেন, যা থাইল্যান্ডের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। যদিও থাইল্যান্ড শেষ দিকে ঘুরে দাঁড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বাংলাদেশের দৃঢ় প্রতিরক্ষা এবং শ্রাবণীর অপ্রতিরোধ্য পারফরম্যান্স তাদের জয় নিশ্চিত করতে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এই জয় প্রমাণ করে বাংলাদেশের নারী কাবাডি দল কেবল জয়ের জন্য নয়, বরং দেশের সম্মান রক্ষার জন্যও বদ্ধপরিকর।
অন্যান্য দলের অগ্রগতি এবং বিশ্বকাপের চিত্র
একই দিনে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেছে গত আসরের রানার্সআপ ইরান। আজ তারা শক্তিশালী নেপালকে ৩৯-১১ পয়েন্টের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে। গ্রুপ পর্ব থেকেই ইরান তাদের অসাধারণ পারফরম্যান্সের মাধ্যমে ফাইনালে ওঠার অন্যতম দাবিদার হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ঘরের মাঠে এই টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই বাংলাদেশ দারুণ ছন্দে ছিল। নিজেদের প্রথম ম্যাচে উগান্ডাকে হারানোর পর দ্বিতীয় ম্যাচে জার্মানির বিপক্ষেও দাপুটে জয় তুলে নেয়। যদিও তৃতীয় ম্যাচে শক্তিশালী ভারতের কাছে পরাজিত হতে হয়, তবে তাদের এই পথচলা ছিল যথেষ্ট সম্মানজনক এবং সেমিফাইনালে ওঠার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে, টুর্নামেন্টের আরেক শক্তিশালী দল ভারত গতকাল উগান্ডাকে ৫১-১৬ পয়েন্টে বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে গ্রুপ সেরা হয়ে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেছে। আগামীকালের ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে তারা মুখোমুখি হবে ‘বি’ গ্রুপের রানার্সআপ দলের সঙ্গে, যে প্রতিপক্ষ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ভারতের ধারাবাহিক পারফরম্যান্স তাদের এই টুর্নামেন্টের শিরোপা জয়ের অন্যতম ফেভারিট হিসেবে উপস্থাপন করছে।
উল্লেখ্য, নারীদের কাবাডি বিশ্বকাপের এটি দ্বিতীয় আসর। সর্বশেষ ২০১২ সালে এই টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এক দশকেরও বেশি সময় পর এই বৈশ্বিক আসরের আয়োজন নারী কাবাডির উন্নয়নে নতুন প্রেরণা যোগাচ্ছে এবং বাংলাদেশের জন্য এই আসরে একটি পদক নিশ্চিত করা নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক অর্জন, যা দেশের ক্রীড়াঙ্গনে এক নতুন মাইলফলক স্থাপন করবে।
