বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনের প্রত্যয়ে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন দেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোকে তাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত নির্বাচন কমিশন ভবনে আয়োজিত এক সংলাপে তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সম্মেলন কক্ষে পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল আগামী দিনের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকর ও ত্রুটিমুক্ত করা।
সিইসি বলেন, “আমি দেখলাম যে এখানে অনেক পুরোনো সংস্থা আছে, যারা অতীতে ইলেকশন অবজারভারের দায়িত্ব পালন করেছে। তো আমি অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চাই না। আমি অলওয়েজ সামনের দিকে তাকাতে চাই। অতীতে অনেক ভুলভ্রান্তি হয়েছে। নানা কারণে এটা হতে পারে। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা সামনে এগোতে চাই।” এই মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি অতীতের ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে একটি উন্নত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ যা আগামী নির্বাচনকে আরও গ্রহণযোগ্য করতে সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার অপরিহার্যতা
নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হচ্ছে, তা নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব তত্ত্বাবধানমূলক ব্যবস্থা বিদ্যমান। তবে, আসন্ন নির্বাচনগুলোতে ইসির নিয়োগ করা পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর মাধ্যমেও নির্বাচনকালীন পরিস্থিতি আরও গভীর ও বিস্তারিতভাবে বুঝতে চায় কমিশন। এই প্রসঙ্গে সিইসি পর্যবেক্ষকদের ভূমিকার উপর জোর দিয়ে বলেন, “আপনাদের চোখ যদি দুষ্ট হয়, প্রপার না হয়, আমাদের ইলেকশনের দেখাটাও সঠিক হবে না।” এর মাধ্যমে তিনি পর্যবেক্ষকদের সততা, নিরপেক্ষতা এবং বস্তুনিষ্ঠতার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেন। পর্যবেক্ষকদের যথাযথ ও নির্মোহ দৃষ্টিই একটি নির্বাচনের সঠিক চিত্র তুলে ধরতে পারে।
সিইসি আরও উল্লেখ করেন যে, পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো মাঠপর্যায়ে যেসব জনবল নিয়োগ করবে, নির্বাচনের আগে তাদের নির্বাচনবিষয়ক সুনির্দিষ্ট ও ব্যাপক প্রশিক্ষণ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এই প্রশিক্ষণ তাদের নির্বাচনী আইন, আচরণবিধি এবং পর্যবেক্ষণের আন্তর্জাতিক মান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেবে, যা তাদের পেশাদারিত্ব ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি করবে। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত পর্যবেক্ষক দল যেকোনো নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধিতে অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা পালন করে।
রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পর্যবেক্ষণ নিশ্চিতকরণ
নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো তাদের নিরপেক্ষতা। সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দীন এই বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন যে, পর্যবেক্ষক সংস্থার লোকেরা যদি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন, তবে তা নির্বাচন প্রক্রিয়ার জন্য একটি গুরুতর আঘাত এবং অত্যন্ত খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। তিনি পরিষ্কার ভাষায় নির্দেশ দেন, “যাদের নিয়োগ করবেন, প্লিজ চেক করবেন যে তারা কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আছেন কি না। কোন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, কোন পার্টির সঙ্গে জড়িত, মিছিল-মিটিংয়ে গিয়েছে…এই মার্কায় ভোট দাও, ওই মার্কায় ভোট দাও। এগুলো যাতে না করে।”
এই নির্দেশনাটি নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকার গুরুত্ব তুলে ধরে। একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য, পর্যবেক্ষকদের অবশ্যই দলনিরপেক্ষ হয়ে কাজ করতে হবে, যাতে তাদের প্রতিবেদন ও পর্যবেক্ষণ প্রশ্নাতীত থাকে। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ এবং মন্তব্য যেন সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও বস্তুনিষ্ঠতা দ্বারা পরিচালিত হয়, সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। পর্যবেক্ষকদের এই ধরনের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বর্জন কেবল নির্বাচন কমিশনের প্রত্যাশাই নয়, বরং একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মৌলিক চাহিদাও বটে।
সবশেষে, সিইসি’র এই আহ্বান এবং নির্দেশনা বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে আরও সুচারু, বিশ্বাসযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক করার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের অঙ্গীকারের একটি প্রতিফলন। পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর জন্য এটি একটি সুস্পষ্ট বার্তা যে, তাদের ভূমিকা কেবল উপস্থিত থাকা নয়, বরং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও নিরপেক্ষতার নীতির প্রতি সম্পূর্ণরূপে দায়বদ্ধ থেকে কাজ করা। এই পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করা সম্ভব হলে, দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিঃসন্দেহে আরও শক্তিশালী হবে।
