More

    ১৫ বছর পরেও নেওয়া হচ্ছে টোল, অবসান চান বাসিন্দারা

    চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর উপর নির্মিত শাহ আমানত সেতু এখন প্রতিদিনের ভোগান্তির এক প্রতিচ্ছবি। তীব্র যানজট, কর্কশ হর্নের অবিরাম ধ্বনি এবং চালক-যাত্রীদের মুখে বিরক্তি ও ক্লান্তির ছাপ—এই দৃশ্য যেন সেতুটির টোল প্লাজা এলাকার নিত্যসঙ্গী। গত মঙ্গলবার বিকেলে যে চিত্র দেখা গেছে, তা এখানকার চিরচেনা দৈনন্দিনতারই এক খণ্ডচিত্র।

    যানজটের নিত্যসঙ্গী শাহ আমানত সেতু: দীর্ঘ পনেরো বছরের অভিযোগ

    ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে সাধারণের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার পর থেকে এই সেতুটি চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। তবে, দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে টোল আদায় প্রক্রিয়া চলমান থাকায় যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী যানবাহন চালকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের অভিযোগ, এই দীর্ঘ সময়ে সেতুর নির্মাণ ব্যয় পুরোপুরি উঠে আসা উচিত ছিল, অথচ এখনো প্রতিবার পারাপারের জন্য মোটা অঙ্কের টোল গুনতে হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান যানবাহনের চাপ এবং টোল আদায়ের এই প্রক্রিয়া সম্মিলিতভাবে শাহ আমানত সেতু এলাকায় এক দীর্ঘস্থায়ী যানজট সৃষ্টি করছে, যা যাত্রী ও চালকদের দুর্ভোগকে চরমে পৌঁছে দিয়েছে।

    জনগণের দাবি ও আন্দোলনের প্রেক্ষাপট

    অপ্রয়োজনীয় টোল আদায়ের এই প্রক্রিয়া শুধু সময়ক্ষেপণই করছে না, বরং অর্থনৈতিক বোঝা হিসেবেও চাপ সৃষ্টি করছে। এই কারণে, চালক ও যাত্রীরা সম্মিলিতভাবে সেতু থেকে টোল প্রত্যাহারের জোর দাবি জানিয়েছেন। তাদের মতে, একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সড়কে অবস্থিত এবং দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহৃত একটি সেতু থেকে টোল আদায় অব্যাহত রাখা অযৌক্তিক। অতীতেও এই দাবিতে একাধিকবার আন্দোলন ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়েছে, কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো সমাধান এখনও আসেনি। এই আন্দোলনগুলো জনমনে টোলমুক্ত সেতুর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নতুন করে সচেতনতা সৃষ্টি করেছে।

    যানবাহনের চাপ ও সাপ্তাহিক পরিসংখ্যান

    বিশেষ করে, সপ্তাহের শেষ তিন দিন—বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার—শাহ আমানত সেতুতে যানবাহনের চাপ তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি থাকে। এই দিনগুলোতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ হাজারেরও বেশি যানবাহন সেতু অতিক্রম করে। অন্যান্য দিনেও এই সংখ্যা কম নয়; প্রতিদিন ২৪ থেকে ২৬ হাজার গাড়ি পারাপার হয়। এই বিপুল সংখ্যক যানবাহনের একমুখী চাপ টোল প্লাজায় এসে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি করে, যা যাত্রীদের মূল্যবান সময় নষ্ট করার পাশাপাশি তাদের শারীরিক ও মানসিক দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ঈদ বা যেকোনো ছুটির দিনে এই যানজটের মাত্রা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।

    সেতুর গুরুত্ব ও নির্মাণ ইতিহাস

    কর্ণফুলী নদীর উপর নির্মিত এটি তৃতীয় সেতু, যা ২০০৬ সালের ৮ আগস্ট ৫৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়। ৯৫০ মিটার দীর্ঘ এই সেতুটি চট্টগ্রাম নগরীর সঙ্গে জেলার দক্ষিণাঞ্চল, বিশেষ করে পটিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়াসহ কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ স্থাপন করেছে। এই সেতুটি এসব অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন যাতায়াত, ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটন শিল্পের বিকাশে অসামান্য অবদান রাখছে। ভৌগোলিকভাবে এর অবস্থান চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

    বর্তমান টোলের হার ও অর্থনৈতিক প্রভাব

    সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, উদ্বোধনের পর থেকেই শাহ আমানত সেতুতে টোল আদায় করা হচ্ছে এবং কয়েক দফা এই টোলের হার বৃদ্ধি করা হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের জন্য নিম্নোক্ত হারে টোল পরিশোধ করতে হয়:

    • তিন চাকার গাড়ি: ৩০ টাকা
    • মিনিবাস: ৫০ টাকা
    • প্রাইভেট কার: ৭৫ টাকা
    • মাইক্রোবাস: ১০০ টাকা
    • বড় বাস: ১৫৫ টাকা
    • মিনিট্রাক: ১৩০ টাকা
    • মাঝারি ট্রাক: ২০০ টাকা
    • বড় ট্রাক: ৩০০ টাকা
    • লম্বা লরি: ৭৫০ টাকা

    এই বর্ধিত টোলের বোঝা শেষ পর্যন্ত পণ্য ও সেবার মূল্যে প্রতিফলিত হয়ে সাধারণ ভোক্তাদের উপর গিয়ে পড়ে, যা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখে। বাণিজ্যিক পরিবহনের ক্ষেত্রে এই টোল ব্যয় তাদের পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি করে, যা শেষ পর্যন্ত বাজারে পণ্যমূল্যের ওপর প্রভাব ফেলে।

    এ অবস্থায়, শাহ আমানত সেতুর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থলে টোল আদায় অব্যাহত রাখা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দানা বাঁধছে। চালক, যাত্রী এবং স্থানীয় জনগণের প্রত্যাশা—কর্তৃপক্ষ জনভোগান্তি লাঘবে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে তরান্বিত করতে দ্রুত টোল প্রত্যাহারের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবে এবং এই গুরুত্বপূর্ণ সেতুটিকে টোলমুক্ত করে সাধারণের জন্য স্বস্তিদায়ক করবে।

    Recent Articles

    Related Stories

    Leave A Reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here