একদা বিএনপির দুর্ভেদ্য দুর্গ হিসেবে পরিচিত রাজশাহী অঞ্চল এখন দলীয় বিভেদ আর অন্তর্দ্বন্দ্বের কষাঘাতে জর্জরিত। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই পুণ্যভূমি থেকে ধানের শীষ প্রতীক অভাবনীয় সাফল্য ছিনিয়ে এনেছিল, যা রাজশাহীর রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। তবে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যখন সম্ভাব্য প্রার্থীরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন দলীয় হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে প্রার্থী ঘোষণা না হওয়ায় স্থানীয় পর্যায়ে চরম অস্থিরতা ও বিভাজন দেখা দিয়েছে। এই অভ্যন্তরীণ সংঘাত ক্রমশই বাড়ছে, যা সংগঠনের ভিত্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে এবং বিরোধী দলগুলোর জন্য উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করছে। বিশেষ করে, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীরা অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন, যা বিএনপির জন্য এক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজশাহীর আসনগুলোতে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ছড়াছড়ি ও বিভক্তির চিত্র
রাজশাহীর প্রতিটি সংসদীয় আসনেই বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা ৬ থেকে ৭ জন। কোনো কোনো আসনে এই সংখ্যা আরও বেশি। প্রতিটি প্রার্থীই নিজ নিজ এলাকায় স্বতন্ত্র বলয় তৈরি করে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। এর ফলস্বরূপ, মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন এবং একেকজন একেক প্রার্থীর পেছনে ছুটছেন। এটি তৃণমূল পর্যায়ে দলের ঐক্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে এবং বিভক্তি-বিভাজনকে প্রকট করে তুলছে। এমনকি এই বিভেদ মাঝে মাঝে রূপ নিচ্ছে সহিংস সংঘাতে। এরই মধ্যে রাজশাহী-১ আসনের তানোর উপজেলায় বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে দুজন নেতা মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারিয়েছেন, যা দলের ভেতরের পরিস্থিতির ভয়াবহতাকেই তুলে ধরে। এই ধরনের ঘটনা দলের ইমেজ ক্ষুণ্ন করার পাশাপাশি কর্মীদের মনোবলও ভেঙে দিচ্ছে।
রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর): সাবেক মন্ত্রীর পরিবারের উত্তরাধিকার ও নতুন মুখ
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনটি একসময় বিএনপির হেভিওয়েট নেতা, সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত ব্যারিস্টার আমিনুল হকের ঘাঁটি ছিল। তিনি এই আসন থেকে পরপর তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বর্তমানে তার ভাই মেজর জেনারেল (অব.) শরীফ উদ্দিন নিয়মিত এলাকায় গণসংযোগ করে যাচ্ছেন এবং তার পক্ষে কর্মীদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন। তবে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় তার নাম একা নয়; সেখানে আরও রয়েছেন খ্যাতিমান শিল্পপতি সুলতানুল ইসলাম তারেক, প্রকৌশলী কেএম জুয়েল, সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহফুজুর রহমান মিলন, স্থানীয় নেতা সাজেদুর রহমান মার্কনি, অধ্যক্ষ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বিপ্লব এবং যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শাহাদাৎ হোসেন শাহীন। কর্মীরা মনে করছেন, নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা ততই বাড়ছে, যা তৃণমূলের বিভক্তিকে আরও গভীর করছে। প্রতিটি সম্ভাব্য প্রার্থীই নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠছেন, কিন্তু এর ফলস্বরূপ দলের সামগ্রিক ঐক্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
রাজশাহী-২ (মহানগর): কমিটিহীনতা ও বিশৃঙ্খল চিত্র
রাজশাহী-২ (মহানগর) আসনেও বিএনপির নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। কয়েক মাস ধরে মহানগর বিএনপির কোনো কার্যকর কমিটি না থাকায় সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এই কমিটিহীনতা একদিকে যেমন সাংগঠনিক কার্যক্রমকে স্থবির করে দিয়েছে, অন্যদিকে নেতৃত্বের শূন্যতা ও অস্থিরতা বৃদ্ধি করেছে। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কদ্বীপগুলোতে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের অসংখ্য ব্যানার ও পোস্টার শোভা পাচ্ছে, যা একদিকে তাদের আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করে, অন্যদিকে দলীয় শৃঙ্খলার অভাব ও অভ্যন্তরীণ বিভেদকেই স্পষ্ট করে তোলে। এই দৃশ্য মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের মধ্যে আরও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে এবং দলের বৃহত্তর লক্ষ্য থেকে তাদের বিচ্যুত করছে। এমতাবস্থায়, দলীয় হাইকমান্ডের দ্রুত ও সুচিন্তিত পদক্ষেপই পারে রাজশাহীতে বিএনপির হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে এবং আসন্ন নির্বাচনে একটি শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াতে।
