আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত আসনভিত্তিক একক প্রার্থী তালিকা প্রায় সম্পূর্ণ করেছে। দলের অভ্যন্তরে ব্যাপক পর্যালোচনা ও কৌশলগত আলোচনার পর, ধারণা করা হচ্ছে যে খুব শীঘ্রই অন্তত আড়াইশ আসনে একক প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হতে পারে। এই পদক্ষেপ বিএনপির নির্বাচনী প্রস্তুতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
কৌশলগত আসন ও জ্যেষ্ঠ নেতাদের ভূমিকা
বিএনপির জন্য ৬০টি আসন নিয়ে বিশেষ স্বস্তি দেখা যাচ্ছে। এই আসনগুলোতে দলের জ্যেষ্ঠ ও অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতারা একক প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত হয়েছেন, যা তাদের জন্য এক প্রকার নিশ্চিন্ত পরিবেশ তৈরি করেছে। এই নেতারা তাদের নিজ নিজ এলাকায় দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার সুবাদে ভোটারদের কাছে বেশ পরিচিত এবং তাদের জয়লাভের সম্ভাবনাও প্রবল। এসব আসনে দলের অন্য কোনো সম্ভাব্য প্রার্থীকে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়নি, যা দলীয় ঐক্য এবং জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বের প্রতি আস্থার প্রতিফলন।
তবে, মিত্র দলগুলোর সঙ্গে আসন ভাগাভাগির ক্ষেত্রে বিএনপি একটি সুচিন্তিত কৌশল অবলম্বন করছে। কিছু আসনে মিত্রদের জন্য ছাড় দেওয়া হবে, যা জোটের সংহতি বজায় রাখতে সহায়ক হবে। অন্যদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতার আসনে বিএনপি কোনোভাবেই দলের কাউকে সবুজ সংকেত না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই কৌশল অন্যান্য মিত্র দল ও জোটের কয়েকজন শীর্ষ নেতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে, যা দলের নিজস্ব স্বার্থ এবং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে বিএনপি তাদের নিজস্ব সাংগঠনিক শক্তি এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
প্রার্থী চূড়ান্তকরণ ও ঐক্যবদ্ধতার বার্তা
জানা গেছে, চলতি মাসেই অন্তত ২৫০টি আসনে একক প্রার্থীদের অনানুষ্ঠানিকভাবে ‘সবুজ সংকেত’ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে তফসিল ঘোষণার পরই তাদের নাম প্রকাশ করা হবে, তবে এই আগাম সংকেত প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রস্তুতিতে সহায়ক হবে। এবার সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতা নিশ্চিত করার ওপর বিশেষভাবে জোর দেওয়া হচ্ছে। দলের হাইকমান্ড মনে করছে, অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার যেকোনো মূল্যে অভ্যন্তরীণ বিভেদ এড়ানো অপরিহার্য। তাই, দল মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে সম্মিলিতভাবে কাজ করার জন্য কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।
ইতিমধ্যেই দলের হাইকমান্ড থেকে ফোন কলের মাধ্যমে কয়েকটি আসনে একক প্রার্থীদের নির্বাচনি গণসংযোগে নামার বার্তা দেওয়া হয়েছে। এই নির্দেশনার পর মনোনীত প্রার্থীরা দ্রুততম সময়ে ভোটের মাঠে নেমে পড়েছেন এবং ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন শুরু করেছেন। তাদের এই প্রাথমিক প্রচার কার্যক্রমে দলের অন্যান্য সম্ভাব্য প্রার্থীরাও সহযোগিতা করছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
দলের নির্দেশনা, মূল্যায়ন ও কঠোর পদক্ষেপ
প্রায় প্রতিদিনই দলের চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে আসনভিত্তিক সম্ভাব্য প্রার্থীদের ডাকা হচ্ছে। এসব বৈঠকে তাঁদের ভোটারদের মন জয় করার কৌশল, ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রয়োজনীয়তা এবং দল মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে নিবেদিতভাবে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে, যারা শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন পাবেন না, তাদের ত্যাগ ও অবদানের ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। এই আশ্বাস দলের ভেতরে এক ধরণের ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করছে, যা ত্যাগী নেতাদের মনোবল অক্ষুণ্ণ রাখতে সাহায্য করবে।
তবে, একইসাথে স্পষ্ট হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে যে, দলীয় নির্দেশনা অমান্য করলে কিংবা ঐক্য বিনষ্ট করার চেষ্টা করলে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দলের এই দ্বিমুখী কৌশল—একদিকে মূল্যায়ন, অন্যদিকে কঠোরতা—পার্টির শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এবং নির্বাচনী কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে সহায়ক হবে বলে মনে করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত এসব তথ্য বিএনপির আসন্ন নির্বাচনী কর্মপরিকল্পনার একটি পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরে।
সূত্র জানিয়েছে, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আসনে ইতিমধ্যেই জ্যেষ্ঠ নেতাদের একক প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন (কুমিল্লা-১), মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (ঠাকুরগাঁও-১), মির্জা আব্বাস (ঢাকা-৮), গয়েশ্বর চন্দ্র রায় (ঢাকা-৩), ড. আব্দুল মঈন খান (নরসিংদী-২), ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু (সিরাজগঞ্জ-২), সালাহউদ্দিন আহমদ (কক্সবাজার-১), মেজর (অব.) হা… প্রমুখ। এই তালিকা থেকে বোঝা যায়, বিএনপি তাদের শক্তিশালী ও অভিজ্ঞ নেতাদের ওপরই ভরসা করছে।
