আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন সরব। বিশেষত, গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনটি পরিণত হয়েছে এক নিবিড় রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞের কেন্দ্রে। সম্ভাব্য প্রার্থীরা দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন ভোটারদের মন জয় করতে, নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে। এই আসনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো, যেখানে মাঠপর্যায়ের প্রচার ও জনসম্পৃক্ততা অর্জনই এখন মুখ্য লক্ষ্য।
নির্বাচনী দৌড়ে প্রধান দলগুলোর অংশগ্রহণ
জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে গাইবান্ধা-৫ আসনে জামায়াতে ইসলামীর একক প্রার্থী হিসেবে আব্দুল ওয়ারেছ আলীর নাম ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোষণার পর থেকেই তিনি নির্বাচনী এলাকার আনাচে-কানাচে, প্রতিটি ভোটারের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছেন। তার নিবিড় জনসম্পর্ক স্থাপন কৌশল তাকে জনমানসে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এনেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এই আসনে একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশীকে নিয়ে নিজেদের প্রস্তুতি শুরু করেছে। অন্তত পাঁচজন সম্ভাব্য প্রার্থী তাদের দলীয় নেতাকর্মীদের মন জয় করতে এবং সাংগঠনিক শক্তিকে সুসংহত করতে নানামুখী কর্মসূচি পালন করছেন। এই অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা দলের সাংগঠনিক গতিশীলতাকেও বাড়িয়ে তুলছে, যা আসন্ন নির্বাচনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট ও জনমতের প্রভাব
গাইবান্ধা-৫ আসনটি যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীবাহিত সাঘাটা ও ফুলছড়ি—এই দুটি উপজেলা নিয়ে গঠিত। এই অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত স্বতন্ত্র ও চ্যালেঞ্জিং। প্রতি বছর নদীভাঙনের কারণে অনেক এলাকার জনপদ এখন চরাঞ্চলে রূপান্তরিত হয়েছে, যা সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। এ কারণে, স্থানীয় ভোটারদের কাছে নদীভাঙন রোধ এবং চরাঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন একটি প্রধান নির্বাচনী ইস্যু। ভোটাররা স্পষ্টতই জানিয়েছেন যে, যারা এই দুর্বিষহ পরিস্থিতি থেকে তাদের রক্ষা করতে সুদূরপ্রসারী ও কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন, তাদের প্রতিই তারা আস্থা রাখবেন। এই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নই হতে পারে তাদের ভোটদানের মূল নির্ণায়ক।
আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের আধিপত্য ও রাজনৈতিক পরিবর্তন
ঐতিহাসিকভাবে গাইবান্ধা-৫ আসনটি দীর্ঘকাল ধরে জাতীয় পার্টির দখলে ছিল। তবে, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে একটি নাটকীয় পরিবর্তন আসে। সে বছর অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া জাতীয় পার্টি থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং পরবর্তীতে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে আসনটি আওয়ামী লীগের দখলে নেন। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এই আসনটিতে আওয়ামী লীগের একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি হয়। যদিও তার আমলে এলাকার উন্নয়ন এবং সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল, তবে রাজনৈতিকভাবে তিনি প্রতিপক্ষকে মাঠে নামতে খুব একটা সুযোগ দেননি। তার মৃত্যুর পর, এই আসনে উপনির্বাচনে ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপন নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হন। তিনিও তার পূর্বসূরির পথ অনুসরণ করে দলীয় আধিপত্য বজায় রাখেন।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও বিরোধী দলের সক্রিয়তা
গত বছরের জুলাইয়ে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এক ভিন্ন মোড় নেয়। এই সময়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কিছুটা আড়ালে চলে যান বা তাদের কার্যক্রমে ভাটা পড়ে। এই সুযোগে, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণার পর পরই বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা নতুন উদ্যমে মাঠে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তারা জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে এবং সাংগঠনিক ভিত্তি পুনরুদ্ধার করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। এই রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণের আকাঙ্ক্ষা এবং জনসমর্থন আদায়ের তীব্র প্রতিযোগিতা এখন এই আসনের রাজনৈতিক বাস্তবতায় দৃশ্যমান।
বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা: প্রত্যাশা ও প্রস্তুতি
গাইবান্ধা-৫ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার নাম শোনা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মাহমুদুন্নবী টিটুল, যিনি গাইবান্ধা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক সংসদ সদস্য রোস্তম আলী মোল্লার সুযোগ্য পুত্র। তার পারিবারিক রাজনৈতিক ঐতিহ্য এবং বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থান তাকে শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। এছাড়াও, মোহাম্মদ আলী এবং জেলা বিএনপির সহসভাপতি ফারুক আলম সরকারও দলীয় মনোনয়ন পেতে জোর লবিং করছেন। প্রতিটি প্রার্থীই নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করতে এবং দলের হাইকমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও গণসংযোগের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছেন। এই মনোনয়ন দৌড় অচিরেই আরও তীব্র আকার ধারণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
