জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা জুলাই সনদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চলমান আলোচনার অংশ হিসেবে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই বৈঠকটি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে এবং সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে ঘিরে থাকা জটিলতা নিরসনে একটি সম্ভাব্য ধাপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ও অংশগ্রহণকারীগণ
গতকাল শনিবার (২৫ অক্টোবর) সকাল সোয়া ১০টায় জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে এই উচ্চপর্যায়ের আলোচনা শুরু হয়। বৈঠকে এনসিপির পক্ষ থেকে একটি শক্তিশালী প্রতিনিধি দল অংশ নেয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন দলের সদস্য সচিব আখতার হোসেন। তার সাথে ছিলেন যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার, জাবেদ রাসিন, খালেদ সাইফুল্লাহ এবং যুগ্ম সদস্য সচিব জহিরুল ইসলাম মুসা। এই প্রতিনিধিদের উপস্থিতি এনসিপির পক্ষ থেকে বিষয়টির প্রতি তাদের গুরুত্বারোপের ইঙ্গিত দেয়।
অন্যদিকে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ সহ কমিশনের অন্যান্য সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। উভয় পক্ষের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি এই আলোচনাকে আরও ফলপ্রসূ করে তোলার পথ খুলে দেয়।
আলোচনার মূল বিষয়বস্তু: জুলাই সনদ ও এনসিপির দাবি
সাক্ষাৎকালে এনসিপির প্রতিনিধি দল জুলাই সনদের বাস্তবায়ন আদেশ, এর আইনি ভিত্তি এবং সনদের অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়াবলী নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে। এনসিপি দীর্ঘদিন ধরেই সনদের আইনি বৈধতা ও সুস্পষ্ট বাস্তবায়ন কাঠামোর ওপর জোর দিয়ে আসছে, যা এই বৈঠকের মূল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল।
পূর্ববর্তী প্রেক্ষাপট: সনদে স্বাক্ষর প্রদানে এনসিপির অনীহা ও শর্তাবলী
উল্লেখ্য, গত ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে এনসিপির কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। সেদিন সকালে দলটি সনদে স্বাক্ষর করার পূর্বে তিনটি সুনির্দিষ্ট শর্ত উত্থাপন করেছিল, যা দেশের রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। শর্তগুলো নিম্নরূপ:
- প্রথমত, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন আদেশের ‘টেক্সট’ এবং গণভোটের প্রশ্নটি চূড়ান্ত করে আগেই জনগণের কাছে প্রকাশ করতে হবে, যাতে জনসাধারণের মধ্যে স্বচ্ছতা ও স্পষ্টতা নিশ্চিত হয়।
- দ্বিতীয়ত, যদি গণভোটের মাধ্যমে জনগণ জুলাই সনদে রায় দেয়, তবে নোট অব ডিসেন্টের (ভিন্নমত) কোনো কার্যকারিতা থাকবে না। এটি সনদের ভবিষ্যৎ বাস্তবায়ন ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
- তৃতীয়ত, গণভোটের রায় অনুযায়ী, আগামী নির্বাচিত সংসদ তাদের ওপর প্রদত্ত গাঠনিক ক্ষমতাবলে সংবিধান সংস্কার করবে। এই শর্তটি সংবিধান সংশোধনে জনগণের প্রত্যক্ষ মতামতকে সর্বাগ্রে রাখার একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
প্রধান উপদেষ্টার সাথে এনসিপির সাক্ষাৎ এবং নতুন প্রস্তাবনা
এরই ধারাবাহিকতায়, গত বুধবার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সহ চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। সেই বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা এনসিপির প্রতি জুলাই সনদে স্বাক্ষর করার জন্য আহ্বান জানান, যা এই সনদের সর্বদলীয় গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে তার আগ্রহের প্রতিফলন।
এই সাক্ষাতকালে এনসিপির পক্ষ থেকে আইনি ভিত্তির নিশ্চয়তার বিষয়টি আবারও জোরালোভাবে উত্থাপন করা হয়। এর পাশাপাশি, এনসিপি একটি যুগান্তকারী প্রস্তাব পেশ করে—জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে প্রধান উপদেষ্টাকে জারি করার দাবি জানায়। এই দাবিটি ক্ষমতা বিন্যাস ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আগামী দিনে আরও আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই বৈঠক এবং এনসিপির উত্থাপিত শর্ত ও প্রস্তাবনাগুলো জাতীয় ঐকমত্য গঠনের প্রক্রিয়ায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
