যশোর জেলা আওয়ামী লীগের (কার্যক্রম স্থগিত) সাবেক সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন, যিনি স্থানীয় মহলে ‘দুর্নীতির রাজা’ হিসেবে পরিচিত, তাঁর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। দরিদ্র কৃষক ও সাধারণ মানুষের জমি জবরদখল করে প্রায় শত বিঘা জমির ওপর একটি সুবিশাল কৃষি খামার গড়ে তোলার পাশাপাশি সরকারি খাসজমি আত্মসাৎ, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য এবং ঘুষের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। বর্তমানে তিনি হত্যা ও চাঁদাবাজিসহ একাধিক মামলায় কারাবন্দী রয়েছেন, যা তাঁর বিতর্কিত রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের প্রতিচ্ছবি।
অবৈধ দখলে গড়া বিশাল কৃষি সাম্রাজ্য
মিলনের এই বিশাল কৃষি খামারটি গড়ে উঠেছে যশোর সদর উপজেলার কাশিমপুর ইউনিয়নের রাহেলাপুর গ্রামে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এর সম্প্রসারণ ঘটে। প্রাথমিকভাবে তাঁর মায়ের সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত মাত্র ১১ বিঘা জমি দিয়ে এর সূত্রপাত হলেও, পরবর্তীতে এটি অভূতপূর্ব ও অস্বাভাবিকভাবে বিস্তার লাভ করে। এই সম্প্রসারণের পেছনে ছিল স্থানীয় অসহায় কৃষকদের জমি অন্যায়ভাবে দখল, ন্যায্য মূল্য না দিয়ে নামমাত্র মূল্যে জমি অধিগ্রহণ, প্রতারণামূলক অদলবদল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জমি আত্মসাৎ, এবং এমনকি সরকারের মালিকানাধীন খাসজমি অবৈধভাবে জবরদখল করা।
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মিলন কাশিমপুরের কালীদার বিল ও বৌদার বিল নামক দুটি গুরুত্বপূর্ণ খাস বিল ভরাট করে তাঁর খামারের সাথে একীভূত করেন। এই খাসজমিগুলোর পরিমাণ প্রায় ৪০ বিঘা বলে ধারণা করা হয়, যা তাঁর ক্ষমতা ও প্রভাবের অপব্যবহারের এক জাজ্বল্য প্রমাণ। বর্তমানে এই সুবিশাল খামারে ৮ থেকে ১০টি সুবৃহৎ পুকুর বিদ্যমান, যেখানে মৎস্য চাষ করা হয়। এছাড়াও, একটি সুসজ্জিত গরুর খামার, একটি অত্যাধুনিক রাইস মিল, বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত এবং একটি বড়সড় আমবাগান রয়েছে, যা তাঁর অবৈধ সম্পদের বিশালতা ফুটিয়ে তোলে।
খামারের সার্বিক দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা আক্তারুজ্জামান নামের এক ব্যক্তি জানান, এই ফার্মে প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ বিঘা জমি রয়েছে। তিনি নিশ্চিত করেন যে, এখানে আটটি পুকুরে মাছ চাষ হচ্ছে এবং গরুর খামারে বর্তমানে প্রায় ১১টি গরু রয়েছে। এছাড়াও, খামারের নিজস্ব একটি রাইস মিল এবং পর্যাপ্ত ধানক্ষেত রয়েছে যা কৃষিভিত্তিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরে। যদিও স্থানীয় মহলে এর আয়তন প্রায় ১০০ বিঘা বলে পরিচিত, তবে ফার্ম কর্তৃপক্ষের এই তথ্য জমির প্রকৃত মালিকানা ও দখল নিয়ে আরও প্রশ্ন তোলে।
ক্ষতিগ্রস্তদের মর্মন্তুদ অভিযোগের ফিরিস্তি
স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে শহিদুল ইসলাম মিলনের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগের পাহাড় জমা হয়েছে। যশোর সদরের পাঁচবাড়িয়া কাছারিপাড়ার বাসিন্দা আব্দুল কাদের এক মর্মন্তুদ অভিযোগ তুলে ধরেছেন। তাঁর ভাষ্যমতে, মিলন যখন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, সেই সময়ে তিনি তাঁর ২৬ শতক জমি ‘অদলবদল’ করার কথা বলে কৌশলে দখল করে নেন। কাদেরকে তিন মাসের মধ্যে জমি ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও, সেই প্রতিশ্রুতি কখনোই রক্ষা করা হয়নি। এর পরিবর্তে, মিলন প্রতি বছর দু’বার ধান হিসেবে সামান্য অর্থ প্রদান করতেন, যা তাঁর জমি দখলের একটি কৌশলী আবরণ ছিল।
একইভাবে, আব্দুল কাদেরের ভাগিনা মইদুল এবং মিথুনদের মালিকানাধীন প্রায় দেড় বিঘা জমিও একই ধরনের প্রতারণার শিকার হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এই ঘটনাগুলো কেবল বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নয়, বরং মিলনের দীর্ঘদিনের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সাধারণ মানুষের সম্পত্তি দখলের এক সুদূরপ্রসারী কৌশলের অংশ হিসেবে প্রতীয়মান। এসব অভিযোগ প্রমাণ করে যে, কীভাবে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি জনস্বার্থকে উপেক্ষা করে নিজের অবৈধ সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে পারেন, যা বিচারপ্রার্থীদের জন্য এক দীর্ঘ প্রতীক্ষার সৃষ্টি করেছে।
