বাংলাদেশের ক্রিকেটের স্বচ্ছতা ও নৈতিকতা বজায় রাখতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) অবৈধ জুয়া বা বেটিংয়ের বিরুদ্ধে এক কঠোর ও আপসহীন অবস্থান নিয়েছে। খেলার পবিত্রতা রক্ষা এবং এই অনৈতিক কার্যকলাপের মূলোৎপাটনে বিসিবি বদ্ধপরিকর। বোর্ডের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা এই অভিযানে নিজেদের জীবননাশের ঝুঁকির মুখেও পিছপা না হওয়ার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেছেন, যা এই গুরুতর সমস্যার প্রতি তাদের অবিচল প্রতিশ্রুতির পরিচায়ক।
জুয়া বন্ধে বোর্ডের ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা ও প্রাণনাশের হুমকি
‘চিলি ফ্লেক্স স্টুডিও’ নামের একটি জনপ্রিয় ইউটিউব পডকাস্টে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল বেটিংবিরোধী এই অভিযানের প্রাথমিক লক্ষ্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানান। তিনি স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেন, “আমাদের প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য হলো ক্রিকেটের অঙ্গন থেকে বেটিংকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা।” এই মহৎ উদ্দেশ্য সাধনে যে ব্যক্তিগত ঝুঁকি জড়িত, সে সম্পর্কেও তিনি অবগত। “আমি জানি, এতে আমাদের প্রাণনাশের হুমকি আসতে পারে,”—উদ্বেগের সঙ্গে জানান তিনি। তবে এই হুমকি তাদের সংকল্পকে বিন্দুমাত্র দুর্বল করতে পারেনি।
বুলবুল আরও জানান, এই অভিযানের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে। সম্প্রতি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে মাঠে বসেই জুয়া কার্যক্রমে জড়িত থাকার অভিযোগে ছয়জনকে শনাক্ত করে আটক করা সম্ভব হয়েছে। এটি কেবল একটি ক্ষুদ্র অংশমাত্র। বেটিংয়ের এই নেটওয়ার্ক এতটাই সুদূরপ্রসারী এবং সংগঠিত যে এটিকে একটি সাধারণ অভিযান হিসেবে না দেখে বিসিবি সভাপতি এটিকে ‘যুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর ভাষায়, “বেটিংয়ের নেটওয়ার্কটা অনেক বড়। কিন্তু আমরা এটাকে যুদ্ধ হিসেবে নিয়েছি — যা হওয়ার হবে।” এই উক্তি বিসিবির অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং যেকোনো প্রতিকূলতা মোকাবিলায় তাদের প্রস্তুতিকে স্পষ্ট করে তোলে।
বিসিবি দুর্নীতি দমন ইউনিটকে শক্তিশালীকরণ: অ্যালেক্স মার্শালের যোগদান
বেটিংয়ের মতো জটিল ও গভীর সমস্যার মোকাবিলায় বিসিবি তার দুর্নীতি দমন ইউনিটকে (BCB-ACU) আরও সুসংহত এবং কার্যকর করতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। এই লক্ষ্য পূরণের অংশ হিসেবে চলতি বছরের আগস্ট মাসে ক্রিকেট দুর্নীতি দমনে বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত একজন বিশেষজ্ঞকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি হলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) গ্লোবাল ক্রিকেট অ্যান্টি-করাপশন ইউনিট (এসিএইউ) এর সাবেক প্রধান অ্যালেক্স মার্শাল। তাঁর এক বছরের জন্য বিসিবিতে যোগদান নিঃসন্দেহে এই ইউনিটকে নতুন মাত্রা দেবে।
বুলবুল বলেন, “আমরা আমাদের অ্যান্টি-করাপশন ইউনিটকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছি।” মার্শাল এর মতো অভিজ্ঞ ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে বিসিবি-এসিএইউ এর সক্ষমতা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইউনিটটিকে আরও অপ্রতিরোধ্য করে তুলতে সাবেক পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাদের মতো কঠোর শৃঙ্খলা ও পেশাদারিত্বে অভ্যস্ত জনবল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এই পদক্ষেপ বেটিং সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বিসিবির অভিযানের গভীরতা ও কার্যকারিতা আরও বাড়াবে।
স্টেডিয়াম সংলগ্ন জুয়ার আখড়া এবং ঘরোয়া ক্রিকেটে অনুপ্রবেশের চেষ্টা
বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল এই বেটিং নেটওয়ার্কের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি জানান, স্টেডিয়ামগুলোর আশপাশে অবস্থিত কিছু ভবনকে অবৈধ জুয়ার আখড়া হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ভবনগুলো মাসিক এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত ভাড়ায় নেওয়া হয় শুধুমাত্র বেটিং পরিচালনার উদ্দেশ্যে। এর থেকে অনুমান করা যায়, এই নেটওয়ার্কের আর্থিক সক্ষমতা এবং সাংগঠনিক ক্ষমতা কতটা শক্তিশালী।
এই বিশাল ও জটিল নেটওয়ার্ক কেবল আন্তর্জাতিক ম্যাচেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটেও তার কালো ছায়া ফেলার চেষ্টা করছে। এটি দেশের ক্রিকেটের মেরুদণ্ডকে দুর্বল করে দিতে পারে এবং তরুণ প্রতিভাদের নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। বুলবুল স্বীকার করেন, “এই নেটওয়ার্ক এত বড় যে ঘরোয়া ক্রিকেটেও ঢোকার চেষ্টা করে।” তিনি আরও যোগ করেন যে, একদিনে এই বিস্তৃত এবং গভীরভাবে প্রোথিত বেটিং সিন্ডিকেটকে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে তিনি আশ্বস্ত করেন যে, “ধীরে ধীরে এটি বন্ধ করা হবে।” এটি একটি সুচিন্তিত এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার ইঙ্গিত বহন করে।
দেশের ক্রিকেট প্রসারে বিসিবির ভাবনা: ভারতের উদাহরণ
বেটিং প্রতিরোধের পাশাপাশি দেশের ক্রিকেটের সামগ্রিক প্রসার ও উন্নয়নেও বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল তার সুদূরপ্রসারী ভাবনা তুলে ধরেন। তিনি ভারতের ক্রিকেট উন্নয়নের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন দিগন্তের ইঙ্গিত দেন। বুলবুল বলেন, “আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত। তাদের আন্তর্জাতিক ভেন্যু আছে ৩০টির বেশি। তাদের ক্রিকেট সমৃদ্ধ হচ্ছে।” ভারতের এই সমৃদ্ধির পেছনে শুধু আন্তর্জাতিক ভেন্যুই নয়, বরং তৃণমূল পর্যায় থেকে প্রতিভাবান খেলোয়াড় তুলে আনার কৌশলও রয়েছে।
তিনি আরও যোগ করেন, ভারত বর্তমানে তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে, যেমন মনিপুর, নাগাল্যান্ড, আসাম ইত্যাদিতে বিশেষ নজর দিচ্ছে, যেখান থেকে নিয়মিতভাবে বিশ্বকাপ খেলার মতো খেলোয়াড় তৈরি হচ্ছে। এই উদাহরণ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বুলবুল মনে করেন, ভারতের মতো বাংলাদেশকেও শুধু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নয়, বরং জেলা পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত অবকাঠামো উন্নয়ন এবং প্রতিভাবান খেলোয়াড় খুঁজে বের করে তাদের সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে দেশের ক্রিকেটের ভিত্তি মজবুত করতে হবে। এর ফলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আরও শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছাতে পারবে এবং দেশের ক্রিকেটকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারবে।
