More

    সাভারে সিটি ইউনিভার্সিটিতে হামলা : ফাঁকা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে আছে ক্ষতচিহ্ন

    মঙ্গলবার সকালে সাভারের বেসরকারি সিটি ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসজুড়ে বিরাজ করছিল এক অস্বাভাবিক নীরবতা, যা সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞের করুণ প্রতিচ্ছবি। একদা কোলাহলপূর্ণ এই শিক্ষাঙ্গন আজ শিক্ষার্থীশূন্য, প্রতিটি কোণে দৃশ্যমান কেবল ভাঙচুর আর অগ্নিসংযোগের স্পষ্ট চিহ্ন। এই চিত্র শুধুমাত্র একটি ভৌত স্থানের ধ্বংসাবশেষ নয়, বরং একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর বয়ে যাওয়া এক ন্যাক্কারজনক তাণ্ডবের নির্মম সাক্ষী।

    বিধ্বস্ত ক্যাম্পাসের করুণ চিত্র

    ক্যাম্পাসের মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করতেই যে চিত্রটি চোখে পড়ে, তা রীতিমতো মর্মস্পর্শী। চত্বরের ঠিক মাঝখানে দাউ দাউ করে আগুনে পুড়ে যাওয়া তিনটি যাত্রীবাহী বাস এবং একটি ব্যক্তিগত গাড়ি পড়ে রয়েছে, যা ঘটনার ভয়াবহতা ও নৃশংসতার স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে। এগুলি কেবল লোহার স্তূপ নয়, বরং শিক্ষাজীবনের স্বপ্ন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদের ওপর আঘাতের প্রতীক। প্রশাসনিক ভবনের দিকে অগ্রসর হলে দেখা যায়, উপাচার্যের কার্যালয়সহ বিভিন্ন কক্ষের আসবাবপত্র সম্পূর্ণ লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে। চেয়ার, টেবিল, আলমারি—সবকিছুই ভেঙেচুরে একাকার। জানালার কাঁচগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, মূল ফটকের কিছু অংশ এবং সীমানা প্রাচীরের একাধিক স্থানও ভাঙনের শিকার হয়েছে। পুরো ক্যাম্পাস জুড়েই এক ধরনের ভীতি এবং শূন্যতা বিরাজ করছে, যা অতীতের প্রাণবন্ত শিক্ষাঙ্গনের সম্পূর্ণ বিপরীত এক চিত্র তুলে ধরেছে।

    সংঘর্ষের সূত্রপাত: ড্যাফোডিল শিক্ষার্থীদের তাণ্ডব

    এই ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের মূলে রয়েছে গত রবিবার রাত থেকে সোমবার ভোর পর্যন্ত আশুলিয়ার খাগান এলাকায় অবস্থিত সিটি ইউনিভার্সিটি এবং একই এলাকার বেসরকারি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঘটে যাওয়া এক ভয়াবহ সংঘর্ষ। প্রাথমিকভাবে ছোট আকারে শুরু হলেও, এই সংঘাত দ্রুতই চরম আকার ধারণ করে। অভিযোগ উঠেছে যে, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা পরিকল্পিতভাবে সিটি ইউনিভার্সিটিতে হামলা চালায় এবং ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালায়। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার ফলে সিটি ইউনিভার্সিটির অবকাঠামো এবং শিক্ষাপরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা শিক্ষাঙ্গনের পবিত্রতাকে কলঙ্কিত করেছে।

    শিক্ষা কার্যক্রম স্থগিত ও ক্যাম্পাস শূন্যকরণ

    সংঘর্ষ এবং পরবর্তীতে সংঘটিত তাণ্ডবের প্রেক্ষিতে সিটি ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গত সোমবার সকাল থেকেই সিটি ইউনিভার্সিটির বহু শিক্ষার্থী হল ছাড়তে শুরু করেন। পরবর্তীতে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি জরুরি ঘোষণার মাধ্যমে আগামী ৪ নভেম্বর পর্যন্ত ক্যাম্পাসের সকল শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে। প্রশাসনের কঠোর নির্দেশে, সোমবার সন্ধ্যার মধ্যেই সকল শিক্ষার্থীকে হল ত্যাগ করতে বলা হয়, যার ফলস্বরূপ পুরো ক্যাম্পাস এখন জনশূন্য। এই আকস্মিক বন্ধ ঘোষণার ফলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে, যা তাদের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নয়।

    নিরাপত্তারক্ষীদের মাঝে বিরাজমান শঙ্কা

    মঙ্গলবার সকালে সিটি ইউনিভার্সিটির এক নিরাপত্তারক্ষী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “গতকালই সবাই (শিক্ষার্থীরা) চলে গেছেন। এখন হলগুলো একদম খালি। এই ধরনের ভয়াবহ হামলা আমাদের জন্য সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল। আমরা সবাই এখনো একটু ভয়ের মধ্যেই আছি, কারণ এমন ঘটনা অতীতে কখনো ঘটেনি।” তার কথায় ক্যাম্পাসের বর্তমান নিস্তব্ধতা এবং কর্মীদের মধ্যে বিরাজমান গভীর ভীতি ও অনিশ্চয়তা স্পষ্ট ফুটে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা কর্মীদের ওপর মানসিক চাপ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তারা সার্বক্ষণিক সতর্ক অবস্থায় রয়েছেন।

    কর্তৃপক্ষের দৃঢ় পদক্ষেপ: মামলা ও তদন্ত কমিটি গঠন

    সিটি ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ এই হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে এবং এর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তারা ইতিমধ্যে থানায় মামলা দায়ের করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যাতে এই জঘন্য ঘটনার সঙ্গে জড়িত সকল অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা যায় এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যায়। একই সঙ্গে, পুরো ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই কমিটি ঘটনার বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করবে, প্রত্যক্ষদর্শী ও ক্ষতিগ্রস্তদের বক্তব্য রেকর্ড করবে এবং ভবিষ্যৎে এমন ঘটনা রোধে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদান করবে। কর্তৃপক্ষের এই দৃঢ় অবস্থান শিক্ষাঙ্গনে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকারের প্রতিফলন।

    উপাচার্যের বক্তব্য: ‘শিক্ষার্থীসুলভ আচরণ ছিল না’

    সিটি ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক লুৎফর রহমান এই ন্যাক্কারজনক ঘটনা সম্পর্কে প্রথম আলোকে বলেন, “যারা এই হামলা চালিয়েছে, তাদের আচরণ কোনো অর্থেই শিক্ষার্থীসুলভ ছিল না। তারা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসাত্মক মনোভাব নিয়ে আমার কার্যালয়সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে হামলা চালিয়েছে, ব্যাপক ভাঙচুর করেছে এবং এমনকি মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাটও করেছে।” তিনি আরও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “আমাদের গাড়িগুলো পরিকল্পিতভাবে আগুন দিয়ে সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যা কেবল সম্পত্তির ক্ষতি নয়, একটি বিদ্বেষপূর্ণ মানসিকতারও পরিচায়ক।” উপাচার্য জানান, তারা আজই সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা দায়ের করবেন এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)-এ লিখিত অভিযোগ জানাবেন। এই অভিযোগের মাধ্যমে তারা কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন যাতে এই ধরনের শিক্ষাবিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ হয়।

    অধ্যাপক লুৎফর রহমান আরও নিশ্চিত করেছেন যে, অভ্যন্তরীণভাবে পুরো বিষয়টির পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করা হবে এবং এর পাশাপাশি উচ্চপর্যায়েও এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার ও ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কর্তৃপক্ষ আশাবাদী যে, দ্রুততম সময়ে অপরাধীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা হবে এবং ক্যাম্পাসে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ দ্রুত ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

    Recent Articles

    Related Stories

    Leave A Reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here