More

    ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে বিএনপি বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ

    বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া সুপারিশমালা। সম্প্রতি, এই সুপারিশমালা নিয়ে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। দলটির অভিমত, যদিও তারা দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তি এবং বৃহত্তম অংশীজন, তবুও ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবনায় তাদের মতামতকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষত, বিএনপির পক্ষ থেকে উত্থাপিত ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা দ্বিমতপত্র সনদে লিপিবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও, বিস্ময়করভাবে তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। এই অপ্রত্যাশিত উপেক্ষা দলের উচ্চপর্যায়ে গভীর বিস্ময় ও তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।

    বিএনপির তীব্র প্রতিক্রিয়া ও অভিযোগ

    গতকাল মঙ্গলবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক জরুরি সভায় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশমালার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এই সভায় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা কমিশনের কার্যকারিতা ও সুপারিশের বিষয়বস্তু নিয়ে তাঁদের হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যুক্তরাজ্য থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভার আলোচনায় উঠে আসে যে, ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা ও প্রস্তাবনার প্রতি পক্ষপাতিত্ব পরিলক্ষিত হয়েছে। এর বিপরীতে, দেশের বৃহত্তম অংশীজন (স্টেকহোল্ডার) হিসেবে বিএনপির সুস্পষ্ট মতামত ও সুপারিশসমূহ সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পরিপন্থী বলে দল মনে করে।

    বিএনপির অভিযোগের মূল ভিত্তি হলো, তাদের ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা দ্বিমতপত্র সনদে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চূড়ান্ত সুপারিশমালায় সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি। এই ধরনের অঙ্গীকার ভঙ্গকে বিএনপি রাজনৈতিক অসাধুতা এবং দলের প্রতি চরম অবজ্ঞা হিসেবে দেখছে। তাদের মতে, এটি কেবল একটি দলের মতামতকে পাশ কাটানো নয়, বরং বৃহত্তর জন আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিনিধিত্বকে অস্বীকার করার শামিল।

    ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশমালার বিতর্কিত দিক

    ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ বাস্তবায়নের সুপারিশমালায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা রয়েছে, যা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় সমালোচিত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান বিষয় হলো, আগামী সংসদ তার নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি প্রথম ২৭০ দিন (নয় মাস) ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ হিসেবে কাজ করবে। এই পরিষদকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গণভোটে পাস হওয়া প্রস্তাবনাগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

    তবে, যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, তা হলো: যদি সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়, তবে সংশ্লিষ্ট বিলগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। এই ‘স্বয়ংক্রিয় অন্তর্ভুক্তি’র বিধানটিকেই বিএনপি নেতারা অত্যন্ত আপত্তিকর ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করছেন। সভায় এই বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত ও গভীর আলোচনা হয়, যেখানে এর সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।

    ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সমালোচনা

    সভায় উপস্থিত একজন সদস্য এই ‘স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত’ হওয়ার প্রক্রিয়াটিকে ইতিহাসের বিতর্কিত কিছু ঘটনার সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি মনে করেন, এই পদ্ধতি পাকিস্তানের সাবেক সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জারিকৃত লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও), ১৯৭০ এবং আইয়ুব খান প্রবর্তিত বেসিক ডেমোক্রেসি বা মৌলিক গণতন্ত্রের মতো স্বৈরাচারী ব্যবস্থার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এলএফও’র মাধ্যমে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা খর্ব করে সাংবিধানিক কাঠামো নির্ধারণের চেষ্টা করেছিলেন, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেছিল। একইভাবে, আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রও ছিল এক প্রকার নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র, যা জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণকে সীমিত করেছিল।

    এই সদস্যের মতে, ঐকমত্য কমিশনের বর্তমান সুপারিশমালা আদতে দুটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবনা এবং কমিশনের নিজস্ব চিন্তাভাবনার একতরফা প্রতিফলন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, এই সুপারিশগুলো গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পরিপন্থী এবং প্রকারান্তরে জাতির ওপর একটি নির্দিষ্ট এজেন্ডা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, যেখানে বৃহত্তম অংশীজনের মতামতকে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। এই তুলনামূলক আলোচনা সুপারিশমালার গণতান্ত্রিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এবং এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব সম্পর্কে গভীর সংশয় সৃষ্টি করেছে।

    Recent Articles

    Related Stories

    Leave A Reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here