More

    ভালোবাসাই যখন ধর্ম হয়ে ওঠে, ঈশ্বরের নাম হয় ডিয়েগো

    ফুটবল ইতিহাসে এমন কিছু নাম আছে যা শুধুমাত্র একটি খেলা নয়, একটি দর্শন, একটি আবেগ। ডিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা সেই বিরল কিংবদন্তিদের মধ্যে একজন, যাঁর নাম শুনলেই কোটি মানুষের হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তাঁর প্রতিটি জন্মদিন তাই শুধুই একটি ক্যালেন্ডার তারিখ নয়, এটি বিশ্বজুড়ে ফুটবলপ্রেমীদের জন্য এক আনন্দোৎসব, এক গভীর শ্রদ্ধার দিন। যদিও ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে তিনি অনন্তলোকে পাড়ি জমিয়েছেন, কিন্তু বেঁচে থাকলে আজ, ৩০ অক্টোবর, তাঁর বয়স হতো ৬৫ বছর। তবুও তাঁর স্মৃতি, তাঁর জাদু আর তাঁর প্রভাব আজও অম্লান, চিরভাস্বর।

    ফুটবল বিশ্বজুড়ে ম্যারাডোনার প্রভাব ছিল অসামান্য। কার্লোস তেভেজ একবার বলেছিলেন, “আর্জেন্টাইনদের কাছে ডিয়েগো ঈশ্বর। সব সময় তাই থাকবেন।” তাঁর এই উক্তিটি ম্যারাডোনার প্রতি দেশবাসীর অগাধ ভালোবাসা ও অবিচল ভক্তির গভীরতা স্পষ্ট করে তোলে। শুধুমাত্র আর্জেন্টিনাই নয়, ইতালির নেপলস শহরও তাঁকে একইভাবে ঈশ্বর জ্ঞান করে, যেখানে তিনি ক্লাবের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছিলেন। ফ্যাবিও ক্যানাভারো এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন যে, “নেপলসবাসীর কাছেও তিনি ঈশ্বর।” বস্তুত, ফুটবল মাঠে তিনি সর্বকালের অন্যতম সেরাদের এক ক্ষুদ্র তালিকায় স্থান পাওয়া একজন মানুষ, যাঁর পায়ের জাদু বিশ্বকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল এবং যার অদম্য স্পৃহা বহুবার দলকে নিশ্চিত পরাজয়ের মুখ থেকে জয় এনে দিয়েছে।

    আর্জেন্টিনার হয়ে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ জয় ছিল তাঁর মুকুটে শ্রেষ্ঠ পালক, যেখানে তিনি একক নৈপুণ্যে দলকে বিশ্বসেরার আসনে বসিয়েছিলেন, উপহার দিয়েছিলেন ফুটবল ইতিহাসের কিছু অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। তাঁর নেতৃত্বে ইতালির নেপোলি নামের তুলনামূলক ছোট একটি দল সিরি ‘আ’ লিগে বিশ্বসেরা ক্লাবের কাতারে উঠে আসার সাহস দেখিয়েছিল, যা ছিল ফুটবলের ইতিহাসে এক রূপকথার গল্প। ম্যারাডোনার জীবন ছিল বর্নাঢ্য, বিতর্কিত এবং একইসাথে মহিমান্বিত। তাঁর প্রভাব এতটাই সুদূরপ্রসারী যে, তাঁর জন্মদিন ফুটবল বিশ্বের এক বিশেষ দিন হিসেবে পালিত হয়, যেখানে ভক্তরা তাঁকে স্মরণ করে গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সাথে। তাঁর জন্মদিনকে কেন্দ্র করে ভক্তদের উন্মাদনা ও ভালোবাসার এক বিশেষ নিদর্শন পাওয়া যায়, যা আজও মুখে মুখে ফেরে।

    ম্যারাডোনার জন্মদিনে এক অদ্ভুত ‘বড়দিন’ উদযাপন: ১৯৯৮ সালের প্রেক্ষাপট

    কিংবদন্তি ম্যারাডোনার জন্মদিনকে ঘিরে এমন আবেগপ্রবণ মুহূর্তের অসংখ্য গল্প ছড়িয়ে আছে বিশ্বজুড়ে। এমনই এক বিশেষ দিনের গল্প ফিরে দেখা যাক, ১৯৯৮ সালের ৩০ অক্টোবরের রাতকে ঘিরে। সেই রাতে রোজারিও শহরের লা তাবলাদা এবং তার আশেপাশে ম্যারাডোনার জন্মদিনের উদযাপন কেমন এক অদ্ভুত রূপ নিয়েছিল, তা আজও অনেক ভক্তের মনে জীবন্ত হয়ে আছে।

    লা তাবলাদার মধ্যরাতের কথোপকথন

    তারিখটি ছিল ১৯৯৮ সালের ৩০ অক্টোবর। রোজারিও শহরের এক শান্ত মফস্‌সল লা তাবলাদার ঘড়িতে তখন রাত ১২টা বেজে ১৫ মিনিট। এরনান আমেজ নামের এক ব্যক্তি নিস্তরঙ্গ নিশুতি রাতের উদ্দেশ্যহীন পায়চারির জন্য বেরিয়েছিলেন। শহর তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, কেবল জোনাকির মিটিমিটি আলো আর দূরের কুকুরের ডাক সেই নিস্তব্ধতা ভাঙছিল। ঠিক এমন সময়ে তাঁর দেখা হলো দীর্ঘদিনের বন্ধু হেক্টর ক্যাম্পোমারের সঙ্গে। অপ্রত্যাশিত এই সাক্ষাতে বন্ধুসুলভ কুশলাদি বিনিময়ের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া শুরু হলো।

    হেক্টর, এরনানকে দেখে অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, “আরে এরনান! কী খবর?”

    এরনান স্মিত হেসে জবাব দিলেন, “এই তো হেক্টর…চলে যাচ্ছে আরকি…তবে আজ তোমাকে একটা বিশেষ শুভেচ্ছা জানাতে চাই: শুভ বড়দিন!

    এরনানের অপ্রত্যাশিত এই শুভেচ্ছায় হেক্টর মুহূর্তের জন্য বিচলিত হয়ে পড়লেন। মধ্যরাতে বড়দিন! বিষয়টি তাঁর কাছে সম্পূর্ণ অর্থহীন মনে হলো। তিনি কপালে ভাঁজ ফেলে জানতে চাইলেন, “মানে কী? এখন বড়দিন কেন?”

    এরনানের কণ্ঠে কোনো দ্বিধা ছিল না। বরং তাঁর চোখে ছিল এক গভীর দ্যুতি। তিনি ধীরে সুস্থে বললেন, “শুভ বড়দিন। একটু ভাবো, বুঝতে পারবে আজ কোন দিন!”

    এরনানের কথা শুনে হেক্টর মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেন। তাঁর মস্তিষ্কে দ্রুত চিন্তার ঝড় বয়ে গেল। ক্যালেন্ডারের তারিখ, বিশেষ কোনো ঘটনা… হঠাৎই তাঁর মনে পড়ল, আজ ৩০ অক্টোবর। এই দিনটি তো ফুটবল জগতের অবিসংবাদিত ‘ঈশ্বর’ ডিয়েগো ম্যারাডোনার জন্মদিন! এই উপলব্ধি আসতেই তাঁর মুখে এক ঝলক আনন্দ ফুটে উঠলো। হেক্টর স্মিত হেসে উচ্চারণ করলেন, “ঠিক বলেছ! শুভ বড়দিন!”

    দুই বন্ধু এরপর একে অপরকে গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে তাদের অকথিত আনন্দ ভাগ করে নিলেন। ম্যারাডোনার প্রতি তাদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা যেন এই প্রতীকী ‘বড়দিন’ উদযাপনের মধ্য দিয়ে এক নতুন মাত্রা পেল। এরপর তারা একে অপরকে শুভরাত্রি জানিয়ে যে যার পথে পা বাড়ালেন, মনের মধ্যে এক অনাবিল প্রশান্তি নিয়ে।

    ফোনকলের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া উৎসবের রেশ

    একই রাতের আরেকটি ঘটনা। তখন প্রায় রাত ১২টা ৪৫ মিনিট। লা তাবলাদা থেকে মাত্র কয়েক ব্লক দূরে লা গুয়ার্দিয়া এলাকায় আলেহান্দ্রো ভেরনের ঘরে বেজে উঠলো টেলিফোন। ক্রিং, ক্রিং, ক্রিং… গভীর রাতে ফোনের শব্দে আলেহান্দ্রো কিছুটা অবাক হলেন। ফোনটা তাঁর বন্ধু এরনানের।

    আলেহান্দ্রো ফোন তুলে বললেন, “হ্যালো?”

    অপর প্রান্ত থেকে এরনানের হাসিমাখা কণ্ঠ ভেসে এলো, “হ্যালো অ্যালে, এরনান বলছি। শুভ বড়দিন!”

    আলেহান্দ্রোর প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল বিস্ময় আর কিছুটা বিরক্তি মেশানো। তিনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, রাত তখন প্রায় ১টা ছুঁই ছুঁই। এই সময়ে বড়দিনের শুভেচ্ছা! তিনি কিছুটা রসিকতা করে বললেন, “এখন রাত (প্রায়) ১টা বাজে। কী খেয়েছ? ফরমালডিহাইড? মাথা ঠিক আছে তো?”

    এরনান হাসলেন। তাঁর সেই একই উত্তর, “একটু ভেবে দেখো। আজ কোন দিন, অ্যালে?”

    আলেহান্দ্রো মুহূর্তের জন্য থামলেন। বন্ধুর এই একই ধাঁধা তাঁকে ভাবিয়ে তুলল। তিনি মনে মনে ক্যালেন্ডার ঘোরালেন, গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলো মনে করার চেষ্টা করলেন। তারপরই তাঁর মুখে সেই একই আনন্দের হাসি ছড়িয়ে পড়ল। “(একটু ভেবে) হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ! আজ ‘ঈশ্বর’–এর জন্মদিন। শুভ বড়দিন, ভাই মারাদোনিয়ান!”

    এই কথোপকথনগুলো কেবল কিছু সাধারণ বন্ধুর শুভেচ্ছা বিনিময় ছিল না। এটি ছিল ডিয়েগো ম্যারাডোনার প্রতি তাঁদের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এক স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ। তাঁর জন্মদিনকে ‘বড়দিন’ হিসেবে আখ্যায়িত করার মাধ্যমে তারা বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, ম্যারাডোনা তাঁদের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং তাঁর জন্ম কতটা উৎসবমুখর এক ঘটনা। পরের দিন সন্ধ্যায়, এই তিন বন্ধুসহ আরও অনেকে মিলে বিয়ারের ক্যান হাতে নিয়ে সেই উৎসবের রেশ ধরে রেখেছিলেন, যা প্রমাণ করে যে, ডিয়েগো ম্যারাডোনা কেবল একজন ফুটবলার ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক সংস্কৃতি, এক বিশ্বাস এবং কোটি মানুষের হৃদয়ের এক অমর অধ্যায়।

    Recent Articles

    Related Stories

    Leave A Reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here