More

    সুন্দরবনের বড় গেছো প্যাঁচা

    বাংলার দক্ষিণ প্রান্তের শ্বাসরুদ্ধকর সুন্দরবন, যেখানে প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে চলে, সেখানকার গহন অরণ্যের কোলে লুকিয়ে থাকা বিস্ময়কর জীববৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণের এক অনন্য অভিপ্রায় নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ২৫শে সেপ্টেম্বর রাতে আমরা খুলনার ঘাট থেকে ‘গাংচিল’ নামক একটি ছোট লঞ্চে আরোহণ করি। উদ্দেশ্য ছিল শেখেরটেক ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রের নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও বিশেষ করে সেখানকার বিরল পাখিদের সান্নিধ্য লাভ করা। শরতের স্নিগ্ধ আবহাওয়া আর গহীন বনের হাতছানি আমাদের মনকে এক অনাবিল মুগ্ধতায় ভরে তুলেছিল।

    কিন্তু প্রকৃতির খেয়াল বোধহয় ভিন্ন ছিল। ঢাংমারী পৌঁছাতেই আমাদের লঞ্চে আকস্মিকভাবে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। এই অপ্রত্যাশিত বিড়ম্বনা আমাদের যাত্রায় এক প্রলম্বিত বিরতি টানে, এবং নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। অবশেষে, দীর্ঘ অপেক্ষার পর দুপুর গড়িয়ে গেলে আমরা শেখেরটেক ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রে পদার্পণ করি। কটকা ও কচিখালীর মতো জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রগুলোর তুলনায় এখানে পর্যটকদের আনাগোনা তুলনামূলকভাবে কম, যা স্থানটিকে এক নির্জন ও শান্ত পরিবেশ দান করেছে। শেখেরটেকের অন্যতম আকর্ষণ হলো একটি প্রাচীন কালীমন্দির, যার আশেপাশে বন্যপ্রাণীর, বিশেষ করে রাজকীয় বাঘের অবাধ বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। তবে এবারের আমাদের সুন্দরবন ভ্রমণের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল প্রচলিত পর্যটন বা ‘মামা’ (বাঘ)-এর দেখা পাওয়া নয়, বরং দুটি নির্দিষ্ট বিরল প্রজাতির পাখির অন্বেষণ। লঞ্চ থেকে নামার পরেই বালিতে বাঘের পায়ের তাজা ছাপ দেখে কিছুটা সম্ভ্রম ও শিহরণ অনুভূত হলো। মনে হলো, গতরাতেই হয়তো কোনো এক শিকারী প্রাণী এখান দিয়ে তার রাজকীয় পদচারণা সেরে গেছে।

    বিরল পাখির সন্ধানে দিনের অভিযান

    আমাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল একটি ক্ষুদ্র বিরল পাখি, যার সন্ধানে আমরা টাওয়ারের দিকে যাওয়া পথের মুখে অপেক্ষা করছিলাম। সকালের মনোরম রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া পাখির ছবি তোলার জন্য আদর্শ মনে হচ্ছিল। চারিদিক ঝলমলে আলোয় উদ্ভাসিত, আর আমরা আশায় বুক বেঁধেছিলাম। কিন্তু সুন্দরবনের আবহাওয়া তার ক্ষণিকের মেজাজ পরিবর্তনের জন্য বিখ্যাত। মুহূর্তের মধ্যেই আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল এবং মাথায় দু-এক ফোঁটা বৃষ্টির আগমন ঘটতেই পাখির খোঁজ ছেড়ে আমাদের ক্যামেরার সুরক্ষার জন্য দ্রুত টাওয়ারের দিকে ছুটতে হলো। প্রকৃতির এমন আকস্মিক পরিবর্তন আমাদের পাখি দেখার পরিকল্পনাকে ব্যাহত করল। বৃষ্টি থামার পর আমরা মন্দিরের আশেপাশের এলাকায় পুনরায় পাখিটির খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। এর আগেও বহু পাখিপ্রেমী এই দুটি স্থানে পাখিটির দর্শন পেয়েছেন বলে আমরা জানতে পেরেছিলাম, তাই আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক। কিন্তু বহুক্ষণ ধরে নিবিষ্টভাবে খুঁজেও আমরা কাঙ্ক্ষিত পাখিটির দেখা পেলাম না। বারবার রোদ-বৃষ্টির এমন লুকোচুরি খেলার কারণে আমরা দিনের আলোয় পাখিটি দেখার সুযোগ হারিয়ে হতাশ মনে লঞ্চে ফিরে এলাম।

    নিশাচর পাখির জন্য রাতের অপেক্ষা

    সূর্য অস্তাচলে গেলে সুন্দরবনের ঘন জঙ্গলে দ্রুত অন্ধকার নেমে আসে, এবং চারিদিক এক নিস্তব্ধ, রহস্যময় আবহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এবার আমাদের প্রস্তুতি ছিল এক নিশাচর বিরল পাখির সন্ধানের জন্য। ক্যামেরা হাতে নিয়ে লঞ্চের সামনের দিকে যে যার মতো সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান গ্রহণ করলাম। চারপাশে নিস্তব্ধতা এতটাই গভীর ছিল যে নিজেদের নিঃশ্বাসের শব্দও যেন কানে বাজছিল। একটি ছোট্ট ডিজিটাল ডিভাইসে আমরা কাঙ্ক্ষিত পাখিটির ডাক (কল) বাজাতে শুরু করলাম। অপেক্ষা দীর্ঘ হলেও ফলপ্রসূ হলো। কিছুক্ষণ পরেই শেখেরটেক খালের অন্য পাড় থেকে সেই ডাকের এক সুদূর প্রতি-উত্তর ভেসে এলো, যা আমাদের মনে নতুন করে আশা জাগাল। ডাকের উৎস লক্ষ্য করে আমরা টর্চ ফেললাম, কিন্তু ঘন জঙ্গলের আবরণে পাখিটিকে স্পষ্ট করে দেখা গেল না।

    প্রায় আড়াই ঘণ্টার নিবিষ্ট ও ধৈর্যশীল চেষ্টার পর অবশেষে পাখিটির সঠিক অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব হলো। এটি পন্টুনের পাশে একটি বিশালাকার গাছে বসেছিল। আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে লঞ্চ থেকে পন্টুনে নামলাম, পাছে পাখিটি আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে উড়ে যায়। কিন্তু আমাদের নৈশ অভিযান সফল হতে গিয়েও হলো না। অত্যন্ত সংবেদনশীল এই প্রাণীটি আমাদের আগমন টের পেয়ে মুহূর্তে উড়ে গিয়ে অন্য একটি গাছে আশ্রয় নিল। প্রকৃতির এই গভীর নির্জনতায় বন্যপ্রাণীর সাথে এমন লুকোচুরি খেলা সত্যিই এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।

    Recent Articles

    Related Stories

    Leave A Reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here