More

    সুনামগঞ্জে জমি থেকে ৫ কোটি টাকার বালু চুরির অভিযোগে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা

    সুনামগঞ্জ, বাংলাদেশ: সুনামগঞ্জের ঐতিহাসিক ধোপাজান নদের তীরবর্তী ব্যক্তিমালিকানাধীন ফসলি জমি থেকে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের বালু চুরির এক গুরুতর অভিযোগে ‘লিমপিড ইঞ্জিনিয়ারিং’ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই অভিযোগ এমন এক সময়ে উঠেছে যখন সরকার অবৈধ বালু উত্তোলন রোধে কঠোর অবস্থানের কথা বলছে, যা পরিবেশ ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির সুরক্ষায় নতুন করে প্রশ্ন তৈরি করেছে। একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এমন বিপুল পরিমাণ বালু চুরির অভিযোগ উত্থাপন এবং এর প্রেক্ষিতে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ স্থানীয় মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

    আইনি পদক্ষেপ ও আদালতের নির্দেশনা

    গত বৃহস্পতিবার সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর আদালতে এই নজিরবিহীন মামলাটি দায়ের করেন সুনামগঞ্জ পৌর শহরের দক্ষিণ আরপিননগর এলাকার বাসিন্দা গোলাম হোসেন। বিচারক মহোদয় অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে মামলাটি আমলে নিয়েছেন এবং দ্রুত তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বিশ্বম্ভরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন। বাদীপক্ষের আইনজীবী মো. নাজমুল হুদা মামলা দায়ের এবং আদালতের এই গুরুত্বপূর্ণ আদেশের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন, যা ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ন্যায়বিচারের একটি প্রাথমিক ধাপ বলে বিবেচিত হচ্ছে। এই নির্দেশনা প্রমাণ করে যে আদালত বালু চুরির মতো পরিবেশ ও সম্পদ বিনষ্টকারী অপরাধের ক্ষেত্রে কতটা কঠোর অবস্থান নিয়েছে।

    বাদীপক্ষের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ

    মামলার এজাহারে বাদী গোলাম হোসেন উল্লেখ করেছেন যে, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার রতারগাঁও মৌজায় ধোপাজান নদের ঠিক পাশেই তাঁর পরিবারের ২ একর ৪০ শতক পৈতৃক ফসলি জমি রয়েছে। এই জমি নিয়ে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে একটি আইনি প্রক্রিয়া চলমান থাকা সত্ত্বেও, অভিযুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লিমপিড ইঞ্জিনিয়ারিং ধোপাজান নদ থেকে বিটি বালু উত্তোলনের সরকারি অনুমতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে তাঁর ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি থেকে বালু উত্তোলন করেছে। অভিযোগ অনুযায়ী, তারা জোরপূর্বক নদের পাড় কেটে এবং মূল্যবান ফসলি জমিকে ধ্বংস করে এই কাজটি করেছে, যা জমির মালিকানার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং গুরুতর পরিবেশগত অপরাধের শামিল।

    জনাব হোসেনের অভিযোগ মতে, গত ২৭ অক্টোবর গভীর রাতে তিনি সংবাদ পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে দেখতে পান, লিমপিড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কর্মীরা শক্তিশালী ড্রেজার ব্যবহার করে নির্বিচারে বালু উত্তোলন করছে। যখন তিনি এই বেআইনি কর্মকাণ্ডে বাধা দেন, তখন তাঁকে সরাসরি প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়, যা তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করে। তাঁর দাবি, এভাবে বেআইনি উপায়ে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের বালু উত্তোলন করে বিক্রি করে দিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। এর ফলস্বরূপ, তার পৈতৃক জমির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইতিমধ্যেই ধোপাজান নদের করাল গ্রাসে বিলীন হয়ে গেছে, যা অপূরণীয় ক্ষতি এবং জমির মালিকের জীবন-জীবিকার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

    ধোপাজান নদের প্রেক্ষাপট ও অবৈধ বালু উত্তোলনের চ্যালেঞ্জ

    প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সুনামগঞ্জ সদর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত ধোপাজান নদটি ভারত সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। এই নদ থেকে বালু উত্তোলনের ইজারা ২০১৮ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে। সেই সময়ে নদ থেকে নির্বিচারে ও অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে এলাকায় ব্যাপক নদীভাঙন, কৃষি জমির বিলীন হওয়া এবং সার্বিক পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা চরম আকার ধারণ করে। এমন ভয়াবহ পরিবেশগত ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ইজারা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। নদটি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন হলেও, নিয়মিত নজরদারি ও কঠোর পদক্ষেপ সত্ত্বেও, এই নদের বিভিন্ন স্থানে অবৈধ বালু উত্তোলনের প্রবণতা যেন থামছেই না। শক্তিশালী সিন্ডিকেটগুলি প্রায়শই রাতের আঁধারে বা লোকচক্ষুর আড়ালে এই ধরনের পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রমে লিপ্ত থাকে, যা শুধুমাত্র সরকারের রাজস্ব ক্ষতি করছে না, বরং স্থানীয় জনজীবন ও পরিবেশের ওপর দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই মামলাটি অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে একটি জোরালো বার্তা দেবে বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে এবং আশা করা হচ্ছে যে, এই আইনি প্রক্রিয়া ধোপাজান নদের পরিবেশ সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

    Recent Articles

    Related Stories

    Leave A Reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here