ক্রিকেট কেবল একটি খেলা নয়; এটি এক গভীর অনুভূতি, এক অলিখিত কাব্য, যার সৌন্দর্য ব্যাখ্যাতীত। হৃদয়ের গভীরে যে অব্যক্ত প্রশান্তি বাসা বাঁধে, তার সম্পূর্ণ প্রকাশ যেমন ভাষায় সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি কখনো কখনো সেই প্রশান্তিই যখন অশ্রুর রূপ ধারণ করে চোখের কোণ বেয়ে নেমে আসে, তখন তার চেয়ে মনোরম দৃশ্য বোধহয় আর হয় না। যদিও অশ্রুকে সাধারণত দুঃখের প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখা হয়, গত রাতে জেমাইমা রড্রিগেজের চোখে যে দীপ্তিময় জল দেখা গেল, তা প্রমাণ করে পৃথিবীতে এমন কিছু সুখের কান্না আছে যা দীঘির স্বচ্ছ জলের চেয়েও স্নিগ্ধ ও পবিত্র। এই দৃশ্য আত্মায় এক অদ্ভুত শান্তি এনে দেয়, মনে করিয়ে দেয় যে জেমাইমাদের মতো নিবেদিতপ্রাণ খেলোয়াড়েরা আছেন বলেই ক্রিকেটের এই অনির্বচনীয় সৌন্দর্য আজও অমলিন।
ক্রিকেটের এই মহিমাময় রূপের কোনো লজিক্যাল ব্যাখ্যা হয় না। একজন কিংবদন্তী যেমন বিরাট কোহলি, যিনি ওয়ানডে ক্রিকেটে ৫১টি শতকের মালিক, যখন অপ্রত্যাশিতভাবে টানা দুটি ইনিংসে শূন্য রানে আউট হওয়ার পর তৃতীয় ইনিংসে ব্যাট হাতে নেমে মাত্র এক রান করেই ব্যাট উঁচিয়ে দর্শককে অভিবাদন জানান – সেই মুহূর্তের সৌন্দর্য আসলে কী দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়? এ যেন এক দীর্ঘ সংগ্রাম ও প্রত্যাশার ভার থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দ, যা কেবল একজন সত্যিকারের যোদ্ধাই অনুধাবন করতে পারেন। আবার, কল্পনার চোখে দেখুন সেই অবিশ্বাস্য দৃশ্য: ১৪১ কিলোমিটার গতির এক ভয়ংকর ইয়র্কারে পায়ে আঘাত পেয়েও যিনি মাঠে দাঁড়াতেই পারছিলেন না, সেই অদম্য শামার জোসেফ যখন সমস্ত শারীরিক যন্ত্রণা উপেক্ষা করে ৭টি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট তুলে নিয়ে দলকে অবিস্মরণীয় জয় এনে দেন, তখন সেই বীরত্বকে কি কেবল “খেলা” বলা যায়? এ যেন রক্তাক্ত আঙুলে তানপুরার তারে তোলা সেই স্বর্গীয় সুরের মতো, যা কষ্টকে ছাপিয়ে এক অন্য মাত্রা দান করে। এই ধরনের মুহূর্তগুলো কেবল পারফরম্যান্স নয়, বরং মানবিক দৃঢ়তা, আবেগ এবং অপ্রতিরোধ্য ইচ্ছাশক্তির প্রতিচ্ছবি।
এই অতুলনীয় মুহূর্তগুলোর গভীরতা এত বেশি যে তা কেবল শব্দ দিয়ে বর্ণনা করা অসম্ভব। এক ধরনের চিরকালীন অতৃপ্তি যেন আমাদের তাড়া করে ফেরে – আরও দেখতে চাওয়ার, আরও অনুভব করার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা। এই অতৃপ্তিই হয়তো আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়, ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা কোনো ভুল সিদ্ধান্ত ছিল না, এমনকি যখন আমরা এই খেলার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি দেখে এক প্রকার “বদহজমের” শিকার হই তখনও। এই খেলাই তো শেখায়, জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায়গুলো যুক্তি বা পরিসংখ্যানের ধার ধারে না, সেগুলো কেবল হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়।
অতি ক্রিকেটের বদহজম: ভালোবাসার বিড়ম্বনা
যে খেলাকে আমরা হৃদয় উজাড় করে ভালোবাসি, সেই খেলাটিই আজ যেন এক অপ্রত্যাশিত “বদহজমের” শিকার। ভালোবাসার এই বিড়ম্বনার মূল কারণ হলো ক্রিকেটের মাত্রাতিরিক্ত পরিবেশনা। টেলিভিশন চ্যানেল পাল্টাতে গিয়েও প্রায়শই আমরা দেখতে পাই অন্য কোনো ক্রিকেট ম্যাচের সরাসরি সম্প্রচার। ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোর যেন কোনো শেষ নেই! একটার রেশ কাটতে না কাটতেই শুরু হয়ে যায় আরেকটা। বিগ ব্যাশ, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল), ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল), পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল) – এই দীর্ঘ তালিকা ফুরিয়ে আসে না। এরপর আছে গ্লোবাল সিক্সটি (জিএসএল), ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (সিপিএল), মেজর লিগ ক্রিকেট (এমএলসি) এবং আরও অজস্র নতুন ও পুরনো লিগ। দর্শকের মনে যখন এক প্রকার ক্লান্তির ছোঁয়া লাগে, তখনই আবার ঘোষণা আসে ‘ইন্ডিয়ান হেভেন লিগ’-এর মতো নতুন কোনো লিগের, যেখানে বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে খেলার কথা শোনা যায়। এই পরিস্থিতিতে, একজন প্রকৃত ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে চোখ ফেরানো যেন এক প্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
এই নিরন্তর ক্রিকেটের ধারা আমাদের প্রিয় খেলাটির প্রতি এক ধরণের বিপরীতমুখী প্রভাব ফেলছে। ভালোবাসা যখন মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায়, তখন তা বিরক্তি বা ক্লান্তি ডেকে আনতে পারে। খেলার প্রতিটি মুহূর্তের মহিমা কমে যায় যখন তা প্রতিনিয়ত আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। বিরল মুহূর্তগুলোও তাদের স্বকীয়তা হারায় যখন এমন মুহূর্ত অহরহ দেখা যায়। এটি ঠিক যেন প্রিয় কোনো খাবারের মতো; দারুণ সুস্বাদু হলেও, প্রতিদিন প্রতিবেলায় একই খাবার খেলে যেমন তার স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়, ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমাদের প্রিয় এই খেলাটির অতিরিক্ত বাণিজ্যিকীকরণ এবং অগণিত লিগের উন্মোচন খেলার আবেদনকে কোথাও যেন ম্লান করে দিচ্ছে, দর্শককে এনে ফেলছে একরকম অবসাদের দোরগোড়ায়। এই ভালোবাসার ঘোরেই আমরা হয়তো ভুলে যাচ্ছি যে, বিরতিহীনতা কখনো কখনো উপভোগের আনন্দকে কেড়ে নেয়।
