সম্প্রতি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দ্বিতীয় টি–টোয়েন্টিতে পরাজয়ের পর বাংলাদেশের ক্রিকেটে এক পরিচিত চিত্র আবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ম্যাচ পরবর্তী পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে দাঁড়িয়ে লিটন দাস প্রকাশ্যেই বোলারদের কাছে যেন দুঃখ প্রকাশ করলেন, যা এক গভীর উদ্বেগের ইঙ্গিত বহন করে। এরপর সংবাদ সম্মেলনে ওপেনার তানজিদ হাসান একই সুরেই কথা বললেন, যেখানে তিনি দলের সামগ্রিক চিত্রটি আরও বড় পরিসরে তুলে ধরেন। তার মতে, প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই বোলাররা তাদের সেরাটা উজাড় করে দিলেও, অধিকাংশ সময়ই হারের দায় বর্তায় ব্যাটসম্যানদের ওপর। এই মন্তব্যে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি দলের এক মৌলিক দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠেছে, যা নিয়ে নতুন করে ভাবনার সময় এসেছে।
ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতা: এক চলমান দুশ্চিন্তা
তানজিদের এই অকপট স্বীকারোক্তিই বাংলাদেশ দলের আসন্ন টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারি–মার্চে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের আগে বাংলাদেশ আর মাত্র চারটি আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টি ম্যাচ খেলবে। এই সীমিত সময়ের মধ্যে যদি ব্যাটসম্যানরা তাদের কাঙ্ক্ষিত ছন্দ ও ফর্ম খুঁজে না পান, তাহলে ‘বোলাররা সাফল্যের আলো ছড়াচ্ছেন, আর ব্যাটসম্যানরা তা ম্লান করে দিচ্ছেন’—এই পরিচিত ছক নিয়েই তাদের বড় মঞ্চের কঠিন লড়াইয়ে নামতে হবে। চলতি বছর বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টি ক্রিকেটও যেন এই একই প্রবণতার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে; বোলারদের ধারাবাহিক সাফল্যের বিপরীতে ব্যাটসম্যানদের পারফরম্যান্সের অধোগতি যেন এক হতাশাজনক চিত্র ফুটিয়ে তুলছে। মাঠের পারফরম্যান্সের সাথে পরিসংখ্যানও এই একই কথাই বলছে, যা দলের জন্য অশনি সংকেত।
বোলারদের অপ্রতিরোধ্য পারফরম্যান্স
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, টেস্ট খেলুড়ে দলগুলোর মধ্যে ওভারপ্রতি কম রান দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বোলাররা এক ঈর্ষণীয় অবস্থানে রয়েছেন। চলতি বছরের পারফরম্যান্সে তারা চতুর্থ স্থানে জায়গা করে নিয়েছেন, যেখানে ২৬টি ম্যাচে তাদের গড় রান দেওয়ার হার মাত্র ৭.৮৩। বাংলাদেশের সামনে থাকা আফগানিস্তান, ভারত ও জিম্বাবুয়ের বোলাররাও গড়ে ওভারপ্রতি সাড়ে সাতের বেশি রান দিয়েছেন, যা বাংলাদেশের বোলারদের দক্ষতা ও নিয়ন্ত্রণের প্রমাণ বহন করে। এই তথ্য প্রমাণ করে যে, বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের বোলিং ইউনিট এক শক্তিশালী এবং কার্যকর শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
একক পারফরম্যান্সেও বাংলাদেশের বোলাররা আন্তর্জাতিক মঞ্চে উজ্জ্বল। এই বছর আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টিতে অন্তত ১০ ওভার বল করেছেন, এমন বোলারদের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশের মোস্তাফিজুর রহমানই ওভারপ্রতি ছয়ের কম রান দেওয়ার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। তার এই অসাধারণ ইকোনমি রেট বিশ্ব ক্রিকেটে তার অবস্থানকে সুদৃঢ় করেছে এবং অন্যান্য দেশের তারকা বোলারদের তুলনায় তাকে এক ধাপ এগিয়ে রেখেছে। শুধু মোস্তাফিজই নন, দলের অন্যান্য বোলাররাও প্রয়োজন অনুযায়ী নিজেদের দায়িত্ব সফলভাবে পালন করে যাচ্ছেন, যা দল হিসেবে বোলিং ইউনিটের গভীরতা এবং সক্ষমতা প্রমাণ করে। অথচ, তাদের এই অসাধারণ প্রচেষ্টা প্রায়শই ম্লান হয়ে যাচ্ছে ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায়, যা জয়ের সুবর্ণ সুযোগগুলোকে হাতছাড়া করে দিচ্ছে।
সাফল্যের আড়ালে ব্যাটিংয়ের দৈন্যদশা
ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হারের আগে বাংলাদেশ চলতি বছর চারটি সিরিজ জিতেছে, যা বাহ্যিকভাবে দলের সাফল্যের ইঙ্গিত দিলেও, এর ভেতরের চিত্র ভিন্ন। এই সিরিজ জয়গুলোর পেছনে বোলারদের অবদান ছিল সিংহভাগ, কিন্তু ব্যাটসম্যানদের পারফরম্যান্স বৈশ্বিক মানদণ্ডে ছিল সাদামাটা এবং প্রত্যাশার চেয়ে অনেক নিচে। ব্যক্তিগতভাবে কিছু ঝলক দেখা গেলেও, ধারাবাহিকতা এবং বড় স্কোর গড়ার সক্ষমতা—এই দুটি ক্ষেত্রেই তারা যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছেন। পাওয়ার প্লে বা ডেথ ওভারে দ্রুত রান তোলার ক্ষেত্রে ব্যাটসম্যানদের দ্বিধা এবং ইনিংসকে দীর্ঘায়িত করতে না পারার প্রবণতা দলের জন্য বারবারই বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা অনেক ম্যাচেই জয়ের সম্ভাবনাকে শেষ করে দিয়েছে।
বোলাররা যখন প্রতিপক্ষকে কম রানে আটকে দিয়ে জয়ের ভিত্তি তৈরি করছেন, তখন ব্যাটসম্যানরা সেই সুযোগকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে যেখানে দ্রুত গতিতে রান তোলা এবং প্রতিপক্ষকে চাপে রাখা জরুরি, সেখানে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা প্রায়শই নিজেদের ওপর চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছেন, যা দলের সামগ্রিক পারফরম্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। স্ট্রাইক রোটেট করতে না পারা, বাউন্ডারি না পাওয়া এবং গুরুত্বপূর্ণ সময়ে উইকেট হারানো—এই সমস্যাগুলো দলকে বারবার ভোগাচ্ছে।
আসন্ন টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে এই ব্যাটিং সমস্যা কাটিয়ে ওঠা বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। বোলারদের ধারাবাহিক চমৎকার পারফরম্যান্সকে যদি ব্যাটসম্যানরা পর্যাপ্ত সমর্থন দিতে না পারেন, তবে বিশ্ব মঞ্চে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা কঠিন হয়ে পড়বে এবং দলের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। একটি ভারসাম্যপূর্ণ এবং সফল টি-টোয়েন্টি দলের জন্য বোলার ও ব্যাটসম্যান উভয়েরই সমানভাবে জ্বলে ওঠা অত্যাবশ্যক। সময় ফুরিয়ে আসছে, এবং এখনই ব্যাটসম্যানদের নিজেদের ফর্ম ও আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা প্রয়োজন, যাতে তারা বোলারদের সাফল্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দলকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারেন।
