রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে এক মর্মান্তিক পারিবারিক হত্যাকাণ্ডের প্রায় তিন সপ্তাহ পর অবশেষে গ্রেপ্তার হয়েছেন অভিযুক্ত দুই আসামি – নিহত ব্যক্তির ভাই ও ভাতিজা। পারিবারিক কলহের জেরে সংঘটিত এই নৃশংস ঘটনার রহস্য উন্মোচনে র্যাবের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার পর রবিবার ভোরে তাদের রাজশাহী নগরীর হারুপুর বাগানপাড়া এলাকা থেকে আটক করা হয়। এই গ্রেপ্তার হত্যাকাণ্ডটির তদন্তে এক নতুন মোড় এনে দিয়েছে।
নিহত ব্যক্তি ছিলেন পর্বত রায় (৪৫)। এই হত্যাকাণ্ডের প্রধান অভিযুক্ত রবীন চন্দ্র রায় (২০) এবং তার বাবা সুকুমার রায় (৫০), যিনি সম্পর্কে নিহত পর্বতের বড় ভাই, উভয়কেই আইনের আওতায় আনা হয়েছে। র্যাবের এই দ্রুত ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপের ফলে বিচারপ্রার্থীরা ন্যায়বিচারের আশা দেখছেন।
আজ সকালে র্যাব-৫ এর অধিনায়ক কার্যালয় থেকে প্রেরিত এক বিস্তারিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই গ্রেপ্তারের খবর নিশ্চিত করা হয়েছে। জানানো হয়েছে, গ্রেপ্তারকৃত রবীন চন্দ্র রায় এবং তার পিতা সুকুমার রায়, উভয়ই গোদাগাড়ী উপজেলার আইহাই রাহী গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা। মর্মান্তিকভাবে নিহত পর্বত রায় ছিলেন সুকুমার রায়-এর ছোট সহোদর। এই ঘটনা পারিবারিক সম্পর্কগুলোর এক অন্ধকার দিক উন্মোচন করেছে, যেখানে সামান্য বিবাদও ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
মর্মান্তিক ঘটনার সূত্রপাত: পারিবারিক কলহ থেকে হত্যাকাণ্ড
র্যাব এবং মামলার এজাহার সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এই হৃদয়বিদারক ঘটনার সূত্রপাত হয় গত ১১ অক্টোবর। সেদিন নিহত পর্বত রায় তার মায়ের সঙ্গে একটি পারিবারিক বিষয় নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। এই বিতর্কের এক পর্যায়ে পর্বতের বড় ভাই সুকুমার রায় এতে হস্তক্ষেপ করলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে ওঠে। দুই ভাইয়ের মধ্যে প্রথমে তীব্র বাদানুবাদ এবং পরবর্তীতে তা হাতাহাতিতে রূপ নেয়।
একইদিন বিকেলে, গ্রামের একটি চায়ের দোকানে বসে থাকা অবস্থায় পর্বত রায় আকস্মিকভাবে একটি বাঁশের লাঠি দিয়ে তার বড় ভাই সুকুমার রায়কে আক্রমণ করেন। পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ মোড় নেয় যখন সুকুমার রায়ের ছেলে, অর্থাৎ নিহত পর্বত রায়ের ভাতিজা রবীন চন্দ্র রায়, দ্রুত বাড়ি থেকে আরেকটি বাঁশের লাঠি নিয়ে এসে তার চাচা পর্বত রায়ের মাথায় অতর্কিত এবং সজোরে আঘাত করে। এই পৈশাচিক আঘাতে পর্বত রায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন, যা তাকে গুরুতর আহত করে তোলে এবং তার জীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়।
এই পৈশাচিক আক্রমণের পর গুরুতর আহত পর্বত রায়কে তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা পর্বত রায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিলেন। কিন্তু তার আঘাত এতটাই গুরুতর ছিল যে, চিকিৎসকদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে পরদিন, অর্থাৎ ১২ অক্টোবর সকালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এই ঘটনা এলাকায় শোকের ছায়া ফেলে দেয় এবং পারিবারিক সহিংসতা কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা আবারও প্রমাণ করে।
মামলা দায়ের ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা
এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে নিহত পর্বত রায়ের স্ত্রী বাদী হয়ে গোদাগাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় রবীন চন্দ্র রায়কে প্রধান আসামি এবং তার বাবা সুকুমার রায়কে দ্বিতীয় আসামি হিসেবে নাম উল্লেখ করা হয়। ঘটনার পর থেকেই অভিযুক্ত পিতা-পুত্র উভয়েই আত্মগোপনে চলে যান এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেন।
মামলা দায়েরের পর থেকেই পুলিশ এবং অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি র্যাব এই ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে। অপরাধীদের অবস্থান শনাক্ত করতে এবং তাদের আইনের আওতায় আনতে গোয়েন্দা নজরদারি ও তথ্য সংগ্রহ প্রক্রিয়া জোরদার করা হয়। প্রযুক্তির সাহায্য এবং স্থানীয় উৎস থেকে প্রাপ্ত গোপন তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব সদস্যরা নিবিড়ভাবে আসামিদের গতিবিধি অনুসরণ করতে থাকেন। দীর্ঘ প্রায় তিন সপ্তাহের নিরলস প্রচেষ্টা এবং সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেই অবশেষে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
গ্রেপ্তার ও পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়া
রবিবার ভোরে, রাজশাহী মহানগরীর হারুপুর বাগানপাড়া এলাকা থেকে রবীন চন্দ্র রায় ও তার বাবা সুকুমার রায়কে গ্রেপ্তার করা হয়। এই গ্রেপ্তার হত্যা মামলার তদন্তে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা ঘটনার সাথে তাদের জড়িত থাকার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে বলে র্যাব সূত্রে জানা গেছে।
গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তাদের আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ড আবেদন করা হতে পারে, যাতে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনের সকল রহস্য এবং এর সাথে জড়িত অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উদঘাটন করা যায়। পারিবারিক কলহের জেরে সংঘটিত এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বদ্ধপরিকর। এই ঘটনা সমাজে পারিবারিক বন্ধনের গুরুত্ব এবং সহনশীলতার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে এক কঠিন বার্তা দেয়।
