More

    সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট শারার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিল জাতিসংঘ

    আসন্ন সোমবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসে এক ঐতিহাসিক বৈঠকে মিলিত হতে যাচ্ছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই উচ্চপর্যায়ের আলোচনার ঠিক প্রাক্কালে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সিরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানের ওপর থেকে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে এক নতুন মোড় উন্মোচন করেছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

    জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত ও এর তাৎপর্য

    জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের উত্থাপিত একটি খসড়া প্রস্তাবের ভিত্তিতে আহমেদ আল-শারার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ১৫ সদস্যবিশিষ্ট নিরাপত্তা পরিষদের মধ্যে ১৪টি দেশ এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে, যা প্রস্তাবটির প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের ব্যাপক সমর্থনের ইঙ্গিত বহন করে। শুধুমাত্র চীন এই ভোটাভুটিতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিল, যা তাদের ঐতিহ্যবাহী নিরপেক্ষ অবস্থানকে প্রতিফলিত করে। প্রেসিডেন্ট আল-শারার পাশাপাশি সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আনাস খাত্তাবের ওপর থেকেও একই সঙ্গে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার সিরিয়ার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পথে একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের চাপ এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পর এই সিদ্ধান্ত আসে।

    গত কয়েক মাস ধরেই যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নিরলসভাবে চাপ প্রয়োগ করে আসছিল। এই প্রচেষ্টাগুলো অবশেষে ফলপ্রসূ হলো, যা সিরিয়ার বর্তমান সরকারের জন্য একটি বড় কূটনৈতিক বিজয়। এটি একদিকে যেমন আহমেদ আল-শারার সরকারকে আন্তর্জাতিক বৈধতা অর্জনে সহায়তা করবে, অন্যদিকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং সম্ভাব্য পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। হোয়াইট হাউসের এই বৈঠক এবং তার আগে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘটনা ইঙ্গিত দেয় যে, সিরিয়াকে ঘিরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি মৌলিক পরিবর্তন আসছে।

    ক্ষমতায় আসা এবং আহমেদ আল-শারার সংগঠনের ভূমিকা

    সিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার ক্ষমতায় আসা এক জটিল রাজনৈতিক পটভূমির ফসল। গত বছরের ডিসেম্বরে তার নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার মাধ্যমে সিরিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এই সামরিক সাফল্যের পরই আহমেদ আল-শারা সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তার ক্ষমতা গ্রহণ সিরিয়ার দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধে এক অপ্রত্যাশিত মোড় এনে দেয় এবং দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সমীকরণে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটায়।

    এইচটিএস, যা একসময় নুসরা ফ্রন্ট নামে পরিচিত ছিল, সিরিয়ায় আল-কায়েদার একটি সহযোগী শাখা হিসেবে কাজ করত। এটি ২০১৪ সালের মে মাস থেকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা সংগঠনটির বিতর্কিত অতীত এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এর জঙ্গি সংশ্লিষ্টতাকে নির্দেশ করে। তবে, ২০১৬ সালে এইচটিএস আল-কায়েদার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয়, যা তাদের আদর্শিক বিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ছিল। এরপর গত জুলাই মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকা থেকে এইচটিএসকে বাদ দেয়, যা সংগঠনের আন্তর্জাতিক অবস্থান পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই পদক্ষেপটি এইচটিএসের প্রতি আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় এবং আহমেদ আল-শারার ক্ষমতা গ্রহণের পথ সুগম করে।

    ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক সম্পর্ক ও আঞ্চলিক প্রভাব

    আহমেদ আল-শারার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং তার আসন্ন হোয়াইট হাউস সফর সিরিয়া ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্পর্কের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি সিরিয়ার বিচ্ছিন্নতা ভেঙে আন্তর্জাতিক মূল স্রোতে ফিরে আসার একটি সুযোগ তৈরি করতে পারে। দীর্ঘদিনের সংঘাত এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার জেরে সিরিয়ার অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামো বিপর্যস্ত। এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ফলে সিরিয়ার পুনর্গঠন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগ সিরিয়া সংকট সমাধানে একটি নতুন কৌশলগত দিকের ইঙ্গিত দেয়, যেখানে কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনা এবং রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে, আহমেদ আল-শারার অতীত সংশ্লিষ্টতা এবং এইচটিএসের বিতর্কিত ইতিহাস এখনো আন্তর্জাতিক মহলে কিছু উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে, যা ভবিষ্যৎ সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে পারে। এই ঐতিহাসিক বৈঠক এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যে কী ধরনের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে, তা সময়ই বলে দেবে।

    Recent Articles

    Related Stories

    Leave A Reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here