ফিলিস্তিনের গাজায় সংঘটিত ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের অভিযোগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং দেশটির উচ্চপদস্থ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে তুরস্ক। এই নজিরবিহীন পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি তুরস্কের অবিচল সমর্থনের এক জোরালো বার্তা দিয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান এবং এর মানবিক পরিণতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে যে গভীর উদ্বেগ চলে আসছে, তুরস্কের এই সিদ্ধান্ত সেই বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
গত শুক্রবার ইস্তাম্বুলের প্রসিকিউটরের কার্যালয় থেকে প্রকাশিত একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতির মাধ্যমে এই চাঞ্চল্যকর খবরটি নিশ্চিত করা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গাজায় ধারাবাহিকভাবে সংঘটিত জাতিগত নির্মূল অভিযান এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে ইসরায়েলি নেতাদের বিচারের মুখোমুখি করার এটি একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ। তুরস্কের বিচার বিভাগীয় এই পদক্ষেপ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ আরও বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আওতাধীন গুরুত্বপূর্ণ ইসরায়েলি কর্মকর্তারা
তুরস্কের জারি করা এই গ্রেপ্তারী পরোয়ানার তালিকায় মোট ৩৭ জন সন্দেহভাজন ইসরায়েলি কর্মকর্তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে গাজায় সংঘটিত অপরাধের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আনা হয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কার্ৎজ, যিনি সামরিক অভিযানের অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারী হিসেবে বিবেচিত এবং তাঁর নির্দেশে গাজায় বহু অভিযান পরিচালিত হয়েছে; দেশটির জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গভির, যিনি প্রায়শই ফিলিস্তিনিদের প্রতি কঠোর মনোভাব প্রদর্শনের জন্য সমালোচিত এবং বিতর্কিত মন্তব্য করে থাকেন; এবং ইসরায়েলের সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আইয়াল জামির, যার নেতৃত্বে গাজায় অসংখ্য সামরিক অভিযান পরিচালিত হয়েছে। যদিও ইস্তাম্বুলের প্রসিকিউটর কার্যালয় থেকে পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হয়নি, তবে এই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্তি তুরস্কের অভিযোগের গুরুত্ব এবং দৃঢ়তাকে বিশেষভাবে তুলে ধরেছে।
তুরস্কের সুনির্দিষ্ট অভিযোগসমূহ: জাতিগত নির্মূল ও মানবতাবিরোধী অপরাধ
তুরস্ক দৃঢ়তার সাথে অভিযোগ করেছে যে, ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস থেকে ইসরায়েল ধারাবাহিকভাবে গাজায় জাতিগত নির্মূল অভিযান (genocide) এবং মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে। ইস্তাম্বুলের প্রসিকিউটর কার্যালয়ের বিবৃতিতে এই অভিযোগের সমর্থনে বেশ কয়েকটি মর্মন্তুদ ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন:
-
২০২৩ সালের ১৭ অক্টোবর আল-আহলি ব্যাপটিস্ট হাসপাতালে ভয়াবহ হামলা চালানো হয়, যার ফলে কমপক্ষে ৫০০ নিরীহ মানুষ নিহত হন। তুরস্ক এই হামলাকে মানবতার বিরুদ্ধে একটি সুস্পষ্ট অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং এর বিচার দাবি করেছে।
-
২০২৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি ইসরায়েলি সেনারা ইচ্ছাকৃতভাবে চিকিৎসা সরঞ্জাম ধ্বংস করে, যা যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে চিকিৎসা সেবা ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়েছে এবং অসংখ্য রোগীর জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। এই কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইনের লঙ্ঘন বলে তুরস্ক দাবি করেছে।
-
গাজাকে দীর্ঘকাল ধরে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে, যার ফলে সেখানকার বাসিন্দারা মৌলিক চাহিদা, খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ এবং মানবিক সহায়তা থেকে মারাত্মকভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। তুরস্কের মতে, এটি ফিলিস্তিনি জনগণের উপর চাপানো একটি সম্মিলিত শাস্তি এবং আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লংঘন।
-
বিবৃতিতে তুরস্ক-ফিলিস্তিন ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের উপর হামলার কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তুরস্কের অর্থায়নে নির্মিত এই গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালটিতে গত মার্চ মাসে ইসরায়েল বোমা হামলা চালায়, যা ফিলিস্তিনিদের জন্য চিকিৎসা সেবার সর্বশেষ আশ্রয়স্থলগুলির একটিকে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং মানবিক বিপর্যয়কে আরও গভীর করেছে।
ইসরায়েলের তীব্র প্রতিক্রিয়া: ‘প্রচারণার কৌশল’ আখ্যা
তুরস্কের এই কঠোর পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ইসরায়েল, এটিকে সম্পূর্ণরূপে ‘প্রচারণার কৌশল‘ হিসেবে বর্ণনা করেছে। ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (পূর্বে টুইটার) দেওয়া এক পোস্টে ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডিয়ন সার ঘৃণাভরে তুরস্কের এই প্রচেষ্টাকে অগ্রাহ্য করে জানান, “ইসরায়েল এমন উদ্দেশ্যমূলক ও ভিত্তিহীন প্রচারণাকে তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করছে।” ইসরায়েল মনে করে, এই পদক্ষেপের পেছনে সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে এবং এটি মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান জটিল পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক উত্তেজনাকে আরও উসকে দেবে।
হামাসের স্বাগত ও প্রশংসা
অপরদিকে, ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস তুরস্কের এই ঘোষণাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছে এবং এর ভূয়সী প্রশংসা করেছে। হামাস এক বিবৃতিতে বলেছে, “এই সাহসী ঘোষণা তুর্কি জনগণ এবং তাঁদের নেতৃত্বের ফিলিস্তিনি জাতির প্রতি আন্তরিক ও দৃঢ় অবস্থানের এক সুস্পষ্ট প্রমাণ। আমরা তুরস্কের এই ন্যায়নিষ্ঠ পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানাই।” হামাস আরও বলেছে যে, এই ধরনের পদক্ষেপ ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য ন্যায়বিচারের পথ সুগম করবে।
পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, তুরস্কের এই পদক্ষেপ ইসরায়েল-তুরস্ক সম্পর্কের উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে এবং আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চলমান মামলাগুলোকে আরও শক্তিশালী করবে। এটি ফিলিস্তিনিদের প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণ এবং ইসরায়েলের উপর চাপ সৃষ্টির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, যা ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বিচার প্রক্রিয়াকে আরও গতিশীল করে তুলবে।
