ইউক্রেনের চলমান সংঘাত নিরসনে বিশ্ব যখন কূটনৈতিক সমাধানের দিকে তাকিয়ে, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বুদাপেস্টে একটি সম্ভাব্য বৈঠক ঘিরে নতুন করে সংশয় দেখা দিয়েছে। এই উচ্চপর্যায়ের আলোচনা, যা ইউক্রেনে একটি যুদ্ধবিরতির পথ প্রশস্ত করতে পারতো, এখন নিজেই এক অনিশ্চয়তার দোলাচলে আটকে পড়েছে।
বৈঠকের সময়সীমা ও প্রস্তুতি নিয়ে মস্কোর অবস্থান
মস্কো থেকে আসা সাম্প্রতিক বিবৃতিতে এই বৈঠক ঘিরে এক ধরনের সংশয় দানা বেঁধেছে। মঙ্গলবার ক্রেমলিন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে, এমন একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের জন্য ‘নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই’, এবং এর প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে যথেষ্ট সময় প্রয়োজন। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ এই বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘প্রারম্ভিকভাবে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়নি’ এবং এটি নিছকই একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী প্রস্তুতি অপরিহার্য। এই ধরনের একটি বৈশ্বিক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের জন্য কূটনৈতিক কাঠামোগত প্রস্তুতি, এজেন্ডা নির্ধারণ এবং উভয় পক্ষের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা প্রয়োজন, যা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
মার্কিন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন ও রাশিয়ার ভিন্নমত
এদিকে, মার্কিন গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনে এই বৈঠক আয়োজনে বিলম্বের পেছনে যুদ্ধবিরতির শর্তাবলী নিয়ে মস্কো ও ওয়াশিংটনের মধ্যেকার গুরুতর মতপার্থক্যকে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। কূটনৈতিক মহলে জল্পনা চলছে যে, ইউক্রেন সংকটের সমাধানকল্পে উভয় দেশের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিস্তর ফারাক রয়েছে। রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকভ এই বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে জানান, ‘বৈঠকের পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করার মতো অনুকূল পরিস্থিতি বা সময় এখনো আসেনি।’ তাঁর এই মন্তব্য দুই প্রভাবশালী শক্তির মধ্যে বিদ্যমান দূরত্বের ইঙ্গিত দেয় এবং সম্ভাব্য আলোচনা শুরুর পথকে আরও জটিল করে তোলে।
ল্যাভরভের ফোনালাপ ও মস্কোর অপরিবর্তিত অবস্থান
অন্যদিকে, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ সোমবার মার্কিন সিনেটর মার্কো রুবিওর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। এই দীর্ঘ এবং সংবেদনশীল আলোচনায় কিছু বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ পেয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা উভয় পক্ষের মধ্যেকার আলোচনার পরিবেশকে প্রভাবিত করতে পারে। তবে ল্যাভরভ দৃঢ়ভাবে জানিয়েছেন যে, ‘আলাস্কার শীর্ষ বৈঠকের পর থেকে মস্কোর অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে’ এবং এই বিষয়টি তিনি সরাসরি রুবিওকে অবহিত করেছেন। মস্কোর এই অপরিবর্তিত অবস্থান বোঝায় যে, তারা তাদের পূর্বনির্ধারিত দাবি বা শর্তগুলো থেকে সরে আসতে ইচ্ছুক নয়, যা আলোচনার টেবিলে একটি কঠিন পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে।
আলাস্কা বৈঠকের সমঝোতা বাস্তবায়নে রাশিয়ার গুরুত্বারোপ
আগামী ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকের স্থান ও সময় নিয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হলেও, রাশিয়া আলাস্কার বৈঠকে অর্জিত সমঝোতাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে এবং সেগুলোর বাস্তবায়নকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। মস্কোর মতে, পূর্ববর্তী আলোচনার ফলস্বরূপ যে বোঝাপড়াগুলো তৈরি হয়েছিল, সেগুলোর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নই ভবিষ্যতের যেকোনো আলোচনার ভিত্তি হওয়া উচিত। উল্লেখ্য, আলাস্কার ওই বৈঠকে প্রেসিডেন্ট পুতিন স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন যে, ইউক্রেন সংঘাতে একটি স্থায়ী এবং টেকসই সমাধান নিশ্চিত করতে হলে এর মৌলিক কারণগুলো নিরসন করা অপরিহার্য। এই ‘মৌলিক কারণ’ নিরসনের ওপর রাশিয়ার জোর দেওয়া তাদের নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে সামনে নিয়ে আসে, যা পশ্চিমা দেশগুলোর অবস্থানের সঙ্গে প্রায়শই সাংঘর্ষিক হয়ে থাকে।
ভবিষ্যৎ পথের অনিশ্চয়তা
সার্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে, ইউক্রেন সংকটের মতো একটি জটিল ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিশ্বের দুই প্রভাবশালী নেতার এই উচ্চপর্যায়ের বৈঠক আয়োজনে বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। দ্বিপাক্ষিক মতপার্থক্য, প্রস্তুতিমূলক জটিলতা এবং পূর্ববর্তী আলোচনার ভিত্তিতে সৃষ্ট প্রত্যাশা – এই সব মিলিয়ে বুদাপেস্টে সম্ভাব্য এই বৈঠক আলোর মুখ দেখবে কিনা, তা এখনো অনিশ্চয়তার চাদরে ঢাকা। ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক পদক্ষেপগুলোই নির্ধারণ করবে এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের ভাগ্য এবং ইউক্রেনের যুদ্ধবিরতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথ।
