আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং পারমাণবিক চুক্তির প্রেক্ষাপটে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপে, ইরান, রাশিয়া ও চীনের রাষ্ট্রদূত এবং জাতিসংঘে নিযুক্ত স্থায়ী প্রতিনিধিগণ সম্মিলিতভাবে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসির কাছে একটি যৌথ চিঠি প্রেরণ করেছেন। এই নজিরবিহীন উদ্যোগটি পারমাণবিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে চলমান আন্তর্জাতিক বিতর্ককে নতুন মাত্রা দিয়েছে এবং বিশেষভাবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব ২২৩১-এর ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর প্রশ্ন তুলেছে।
কূটনৈতিক উদ্যোগের প্রেক্ষাপট
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাজেম ঘারিবাবাদি তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘এক্স’-এ এই চাঞ্চল্যকর তথ্যের বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। ঘারিবাবাদি জানান যে, গত ১৮ অক্টোবর রাশিয়া, চীন ও ইরান জাতিসংঘের মহাসচিব এবং নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির কাছে একটি যৌথ চিঠি পাঠিয়েছিল, যেখানে তারা ‘জাতিসংঘের প্রস্তাব ২২৩১-এর সমাপ্তি’ ঘোষণা করে। সেই কূটনৈতিক ধারাবাহিকতা বজায় রেখে, তিন দেশের রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধিরা এবার আইএইএ মহাপরিচালকের কাছে এই নতুন যৌথ চিঠিটি পাঠিয়েছেন। এই পদক্ষেপটি পারমাণবিক বিস্তার রোধ সংক্রান্ত বৈশ্বিক কাঠামোতে একটি স্পষ্ট বার্তা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
মূল দাবি ও বৈধতার প্রশ্ন
প্রেরিত চিঠিতে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি—এই তিন ইউরোপীয় দেশের ‘স্ন্যাপব্যাক প্রক্রিয়া’ সক্রিয় করার পদক্ষেপকে সম্পূর্ণ অবৈধ বলে অভিহিত করা হয়েছে। স্ন্যাপব্যাক প্রক্রিয়া হলো একটি কৌশল যার মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক চুক্তি (জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন বা জেসিপিওএ) লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনরায় আরোপ করা যেতে পারে। চিঠিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রস্তাব ২২৩১-এর সকল ধারা গত ১৮ অক্টোবর থেকে কার্যকরভাবে সমাপ্ত হয়েছে। এই ঘোষণা আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনৈতিক মহলে তীব্র আলোচনার জন্ম দিয়েছে, কারণ এটি আন্তর্জাতিক চুক্তির ব্যাখ্যা এবং প্রয়োগ নিয়ে মৌলিক প্রশ্ন তৈরি করছে।
আইএইএ-এর যাচাই ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার সমাপ্তি
এই চিঠির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এটি প্রস্তাব ২২৩১ এবং যৌথ সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা (জেসিপিওএ)-এর আলোকে আইএইএ মহাপরিচালকের যাচাই ও পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত রিপোর্টিংয়েরও সমাপ্তি ঘোষণা করেছে। এর অর্থ হলো, তিন দেশ মনে করে যে, আইএইএ-এর এখন থেকে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে প্রস্তাব ২২৩১-এর অধীনে কোনো যাচাই বা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আইনি ভিত্তি নেই। এই ঘোষণা আইএইএ-এর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, কারণ সংস্থাটি বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘারিবাবাদি আরও ব্যাখ্যা করে বলেন যে, আইএইএ-তে ইরান সংক্রান্ত যাচাই ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মূলত প্রস্তাব ২২৩১ এবং ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর গভর্নরস বোর্ডের গৃহীত রেজোলিউশনের ভিত্তিতে। ওই রেজোলিউশনের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে যে, বোর্ড এই বিষয়টি তাদের এজেন্ডায় রাখবে ১০ বছর পর্যন্ত, অথবা যতদিন না আইএইএ মহাপরিচালক ইরান সংক্রান্ত পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে চূড়ান্ত শর্তাবলী পূরণ বা একটি সর্বসম্মত ও স্থায়ী সমাধানে পৌঁছানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিন দেশের এই যৌথ ঘোষণা অনুযায়ী, সেই ১০ বছরের সময়সীমা এবং/অথবা চুক্তির প্রাসঙ্গিক ধারাগুলির কার্যকারিতা সমাপ্ত হয়েছে, যার ফলস্বরূপ আইএইএ-এর ওপর থেকে এই বিশেষ দায়িত্বভার শেষ হয়েছে। এই দাবি আন্তর্জাতিক মহলে চুক্তির মেয়াদ এবং এর আইনি কার্যকারিতা নিয়ে নতুন বিতর্কের জন্ম দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
