More

    ভয়াবহ ‘সুনামি’র কবলে ইসরাইল!

    গাজায় চলমান যুদ্ধবিরতির আলোচনা এবং পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের বিতর্কিত দখলদারিত্বের বিল পাসের মধ্যেই ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল এক অভূতপূর্ব জনমিতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। দখলদার এই রাষ্ট্রটি এক ভয়াবহ ‘জন-সুনামি’র কবলে পড়েছে, এমন বিস্ফোরক তথ্য জানিয়েছেন খোদ ইসরায়েলি সংসদ সদস্য গিলাদ কারিভ। এই অপ্রত্যাশিত অভ্যন্তরীণ সংকট ইসরায়েলের ভবিষ্যত নিয়ে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

    ইসরায়েলের ইতিহাসে নজিরবিহীন মানবসম্পদ হ্রাস

    সম্প্রতি দেশটির পার্লামেন্ট, নেসেট-এ পেশ করা একটি বিশেষ প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছে, তা রীতিমতো স্তম্ভিত করার মতো। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের শুরু থেকে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ১ লাখ ২৫ হাজারেরও বেশি ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী তাদের মাতৃভূমি ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এত স্বল্প সময়ের মধ্যে মানবসম্পদের দিক থেকে ইসরায়েলের ইতিহাসে এটিকেই সবচেয়ে বড় ক্ষতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা দেশটির জন্য একটি গভীর সংকট নির্দেশ করে। এই ব্যাপক দেশত্যাগ কেবল সংখ্যার দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি ইসরায়েলের সামাজিক কাঠামো, অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং দীর্ঘমেয়াদী জনমিতিক ভারসাম্যের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

    গত ২০ অক্টোবর ইসরায়েলি পার্লামেন্টের ইমিগ্রেশন ও অ্যাবসরপশন কমিটিতে উপস্থাপিত এক বিস্তারিত প্রতিবেদনে এই জনমিতিক পরিবর্তনের সুস্পষ্ট চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের শুরু থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত ইসরায়েলের নিট অভিবাসন ভারসাম্য – অর্থাৎ যারা স্থায়ীভাবে দেশ ত্যাগ করেছেন কিন্তু ফিরে আসার কোনো পরিকল্পনা নেই, তাদের সংখ্যা থেকে দীর্ঘমেয়াদি প্রত্যাবর্তনকারীদের বাদ দিলে – মোট ১ লাখ ২৫ হাজার ২০০ জনের এক উদ্বেগজনক হ্রাস দেখা গেছে। এই সংখ্যা দেশের জন্য একটি বড় ধরনের জনমিতিক রক্তক্ষরণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

    গাজা যুদ্ধ ও দেশত্যাগের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা

    প্রতিবেদনটিতে আরও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, গাজায় ইসরায়েলের চলমান গণহত্যামূলক যুদ্ধ এই স্থায়ী দেশত্যাগের সংখ্যাবৃদ্ধিতে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। যুদ্ধকালীন অস্থিরতা, নিরাপত্তা উদ্বেগ, আন্তর্জাতিক চাপ এবং অভ্যন্তরীণ সামাজিক বিভাজন – এই সবকিছুই ইসরায়েলিদের মধ্যে দেশ ছাড়ার প্রবণতা বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, গাজা যুদ্ধ যেহেতু এখনো চলমান রয়েছে, ২০২৫ সালেও এই দেশত্যাগের প্রবণতা অব্যাহত থাকবে এবং পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।

    উক্ত কমিটির চেয়ারম্যান এবং সংসদ সদস্য গিলাদ কারিভ এই পরিস্থিতিকে অত্যন্ত গুরুতর আখ্যায়িত করে বলেছেন, “এটি কেবল অভিবাসনের একটি ঢেউ নয়, এটি একপ্রকার সুনামি, যেখানে ইসরায়েলিরা স্বেচ্ছায় দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।” তার এই মন্তব্য ইসরায়েলের অভ্যন্তরে বিরাজমান গভীর হতাশা এবং অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত দেয়।

    বছরভিত্তিক দেশত্যাগের পরিসংখ্যান

    কনেসেট রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন সেন্টার কর্তৃক প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদনটি দেশত্যাগের বছরভিত্তিক একটি বিভাজনও উপস্থাপন করেছে, যা এই প্রবণতার ক্রমবর্ধমান তীব্রতা বোঝায়।

    • ২০২২ সালে: প্রায় ৫৯,৪০০ ইসরায়েলি দেশ ছেড়েছেন।
    • ২০২৩ সালে: এই সংখ্যা বেড়ে সর্বোচ্চ ৮২,৮০০ জনে পৌঁছায়, যা এক বছরের ব্যবধানে একটি বড় উল্লম্ফন নির্দেশ করে।
    • ২০২৪ সালের প্রথম আট মাসে: প্রায় ৫০,০০০ জন দেশত্যাগ করেছেন, যা বছরের বাকি সময় ধরে এই প্রবণতা বজায় থাকলে ২০২৩ সালের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে।

    তুলনামূলকভাবে, ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি অভিবাসনের বার্ষিক হার ছিল অনেক কম, যা বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও নজিরবিহীন করে তোলে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের দেশত্যাগ ইসরায়েলের ভবিষ্যৎ কর্মশক্তি, উদ্ভাবন এবং সামরিক সক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন। এটি কেবল একটি জনমিতিক সংকট নয়, বরং ইসরায়েলের আত্মপরিচয় এবং স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

    Recent Articles

    Related Stories

    Leave A Reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here