লেবাননের প্রতিরোধকামী গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর উচ্চপদস্থ নেতৃত্ব তাদের আদর্শিক দৃঢ়তা এবং আত্মত্যাগের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। সংগঠনটির মহাসচিব, শেখ নাঈম কাসেম, সম্প্রতি এক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারে হিজবুল্লাহর প্রতিটি সদস্যের গভীর প্রতিশ্রুতির কথা তুলে ধরেছেন, যেখানে তিনি নিজেও এই আত্মোৎসর্গের অংশ বলে দাবি করেছেন। এই বিবৃতি কেবল একটি রাজনৈতিক দলের বার্তা নয়, বরং একটি সুদূরপ্রসারী কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং জনকল্যাণের প্রতি নিবেদিত।
আত্মোৎসর্গের অবিচল অঙ্গীকার: হিজবুল্লাহর মূলমন্ত্র
হিজবুল্লাহর মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গত রোববার (২৬ অক্টোবর) আল-মানার নেটওয়ার্ককে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে শেখ নাঈম কাসেম তার সংগঠনের মূল আদর্শ ব্যাখ্যা করেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, “হিজবুল্লাহর প্রতিটি সদস্য, আমি নিজেও আত্মত্যাগে অঙ্গীকারবদ্ধ। ফ্রন্টলাইনে যারা লড়ছেন, এমনকি যারা পরিবার হারিয়েছেন—সবাই এই অঙ্গীকারের অংশ।” এই উক্তিটি হিজবুল্লাহর কর্মীদের ব্যক্তিগত ত্যাগ এবং বৃহত্তর লক্ষ্যের প্রতি তাদের সম্মিলিত নিবেদনকে তুলে ধরে। এটি কেবল যুদ্ধের ময়দানের আত্মত্যাগ নয়, বরং সামাজিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনেও জনগণের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করার এক ব্যাপক প্রতিজ্ঞার ইঙ্গিত বহন করে।
একটি কৌশলগত প্রকল্প: মানুষের সমস্যা সমাধানে নিবেদিত
শেখ নাঈম কাসেম হিজবুল্লাহকে একটি সাধারণ রাজনৈতিক বা সামরিক গোষ্ঠী হিসেবে সংজ্ঞায়িত না করে, এটিকে একটি “কৌশলগত প্রকল্প” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, “এটি একটি সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এটি মানুষের সমস্যা ও উদ্বেগের সমাধানে মনোযোগী এবং প্রতিটি চ্যালেঞ্জে অবস্থান স্পষ্ট।” এই বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায়, হিজবুল্লাহ কেবল সামরিক প্রতিরোধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং লেবাননের জনগণের দৈনন্দিন জীবন, তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাগত উন্নয়নেও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে চায়। প্রতিটি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তাদের সুস্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ এবং সমস্যার মূলে প্রবেশ করে সমাধানের চেষ্টা করাই তাদের এই কৌশলগত প্রকল্পের মূল ভিত্তি।
প্রতিরোধ: কেবল একটি কৌশল নয়, জীবনের পথ
হিজবুল্লাহর অস্তিত্বের মূলে রয়েছে প্রতিরোধের ধারণা। শেখ নাঈম কাসেম এই প্রতিরোধকে কোনো ক্ষণস্থায়ী কৌশল হিসেবে দেখেন না, বরং এটিকে “আমাদের জীবনের পথ” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “আমরা ক্লান্ত হই না, এবং ক্লান্তির কারণে আত্মসমর্পণ করা আমাদের স্বভাববিরুদ্ধ। হিজবুল্লাহর পথ অটুট ও অবিচল।” এই মন্তব্য হিজবুল্লাহর আদর্শিক স্থিতিশীলতা এবং তাদের দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরোধের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন ঘটায়। আগ্রাসন এবং ভূমি দখলের মতো পরিস্থিতিতে তাদের সুনির্দিষ্ট ও অবিচল অবস্থান গ্রহণের আবশ্যকতাকে তারা নিজেদের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করে। অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক বঞ্চনা, বা শিক্ষাগত প্রতিবন্ধকতা—যেকোনো চ্যালেঞ্জেই হিজবুল্লাহর প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য বলে বিবেচিত হয়। এটি তাদের জন্য কেবল একটি সামরিক দর্শন নয়, বরং একটি ব্যাপক জীবনদর্শন, যা তাদের প্রতিটি কর্ম ও সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে।
সম্মিলিত নেতৃত্ব এবং জনগণের শক্তি
হিজবুল্লাহর কার্যক্রম এবং তাদের চলমান প্রতিরোধ সংগ্রাম একক কোনো ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়। শেখ নাঈম কাসেম দৃঢ়তার সাথে বলেছেন যে, “হিজবুল্লাহ এই যুদ্ধ পরিচালনা করেছে এর নেতৃত্ব, পরামর্শ পরিষদ, যোদ্ধা এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে।” তিনি নিজে নেতৃত্ব দিতে আত্মবিশ্বাসী হলেও, এই সংগঠনে একক ক্ষমতার ধারণা নেই। তিনি আরও যোগ করেন, “শুধু আমি একা নই—এই সংগঠনে রয়েছে পরামর্শ পরিষদ, নেতৃত্ব, যোদ্ধা ও জনগণের দৃঢ় সমর্থন।” এই বিবৃতি হিজবুল্লাহর অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক কাঠামো, যেখানে পরামর্শ পরিষদ এবং সামরিক নেতৃত্বের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া কার্যকর, সেদিকে ইঙ্গিত করে। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন এবং যোদ্ধাদের আত্মত্যাগই তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে কাজ করে, যা হিজবুল্লাহকে যেকোনো প্রতিকূলতা মোকাবিলায় সক্ষম করে তোলে। ইসরাইলের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে চলমান সংগ্রামে এই সম্মিলিত শক্তি এবং অবিচল জনসমর্থনই হিজবুল্লাহর প্রতিরোধকে আরও সুসংহত করেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
