More

    ট্রাম্পের কাছে কেন ক্ষমা চাওয়ার কথা বললেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী

    কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কে এক অপ্রত্যাশিত টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে, যার মূলে রয়েছে প্রায় চার দশক পুরোনো একটি শুল্কবিরোধী বিজ্ঞাপন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট তীব্র বিরোধের পর কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চেয়েছেন। এই পদক্ষেপ দুই ঐতিহ্যবাহী মিত্র দেশের মধ্যে চলমান বাণিজ্য উত্তেজনাকে প্রশমিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ চেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

    বিতর্কিত বিজ্ঞাপন এবং ট্রাম্পের ক্ষোভ

    ঘটনার সূত্রপাত ১৯৮০-এর দশকে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের প্রচার করা একটি শুল্কবিরোধী বিজ্ঞাপনকে ঘিরে, যা সম্প্রতি কানাডার অন্টারিও প্রদেশে পুনরায় সম্প্রচারিত হয়। এটি এমন এক সময়ে ঘটল, যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতির অধীনে বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর কঠোর শুল্ক আরোপের মাধ্যমে বৈশ্বিক বাণিজ্য যুদ্ধ চালাচ্ছেন। রিগ্যানের সেই বিজ্ঞাপনটি ট্রাম্প প্রশাসনের বর্তমান সংরক্ষণবাদী বাণিজ্য নীতির সরাসরি বিরোধিতা করে, যা ট্রাম্পকে গভীরভাবে ক্ষুব্ধ করে তোলে। এই অপ্রত্যাশিত বিজ্ঞাপন সম্প্রচার দুই দেশের সম্পর্কে নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি করে এবং কূটনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা তৈরি হয়।

    বিজ্ঞাপনটির সম্প্রচার ট্রাম্পকে এতটাই ক্রুদ্ধ করে তোলে যে তিনি কানাডার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দেন। তিনি শুধু কানাডার পণ্যের ওপর বিদ্যমান শুল্কের সঙ্গে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেননি, বরং কানাডার সঙ্গে সমস্ত বাণিজ্য আলোচনা তৎক্ষণাৎ স্থগিত করারও হুঁশিয়ারি দেন। এই ঘোষণা কানাডার অর্থনীতির জন্য একটি বড় ধাক্কা ছিল এবং এটি দুই দেশের দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক ও বাণিজ্যিক আস্থার ওপর গুরুতর প্রশ্ন তোলে।

    মার্ক কার্নির ক্ষমা প্রার্থনা ও দায়িত্ববোধ

    এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা (এপেক)-এর সম্মেলনে যোগ দিতে বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়া সফরে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি। সেখানেই গত শনিবার (স্থানীয় সময়) তিনি সাংবাদিকদের সামনে এই পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন এবং তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করেন। কার্নি স্বীকার করেন যে, কানাডার বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চলমান বাণিজ্য আলোচনা ও সম্পর্ক সঠিকভাবে পরিচালনা করার দায়িত্ব তারই।

    অন্টারিওতে প্রচারিত বিজ্ঞাপনটির প্রসঙ্গে মার্ক কার্নি সরাসরি বলেন, “আমি প্রেসিডেন্টের (ট্রাম্প) কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছি। তিনি বেশ ক্ষুব্ধ ছিলেন।” তিনি আরও যোগ করেন, “প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার দায়িত্ব আমারই। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে বৈদেশিক সম্পর্কের বিষয়টি ফেডারেল সরকার দেখভাল করে।” পরিস্থিতির গুরুত্ব স্বীকার করে তিনি দার্শনিক ভঙ্গিতে বলেন, “ঘটনা তো ঘটেই—ভালো-মন্দ দুটোই। আমি দুঃখ প্রকাশ করেছি।” কার্নির এই বক্তব্য তার কূটনৈতিক বিচক্ষণতা এবং পরিস্থিতি শান্ত করার ঐকান্তিক আগ্রহ প্রকাশ করে, যা সংকটময় মুহূর্তে নেতৃত্ব প্রদানের একটি দৃষ্টান্ত।

    ব্যাপক বাণিজ্য নীতির প্রেক্ষাপট

    এই ঘটনা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বৃহত্তর বাণিজ্য নীতির প্রেক্ষাপটে আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদ থেকে শুরু করে বিশ্বের প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার দেশগুলোর পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপের উদ্যোগ নিয়েছেন, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন শিল্পকে সুরক্ষিত করা এবং দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমানো। ধনী দেশগুলোর জোট জি-৭-এর সদস্য দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র কানাডাই এখনো পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শুল্ক বিষয়ে কোনো কার্যকর চুক্তিতে পৌঁছাতে পারেনি, যা তাদের সম্পর্ককে আরও নাজুক করে তুলেছে।

    এই শুল্কযুদ্ধ শুধু অর্থনীতিতেই নয়, বরং দীর্ঘদিনের মিত্র দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস এবং সহযোগিতার ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব ফেলছে। কানাডার ওপর ট্রাম্পের এই ক্ষোভ সেই বৃহত্তর বাণিজ্য বিবাদেরই একটি অংশ, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় অস্থিরতা সৃষ্টি করছে এবং বিশ্বজুড়ে দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনর্নির্মাণের প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরছে। এই ধরনের কূটনৈতিক টানাপোড়েন ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও সম্পর্কের গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করা হচ্ছে।

    Recent Articles

    Related Stories

    Leave A Reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here